পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লোকেরা কন্যা দেখিতে আসিবেন। রামেশ্বর খুঁড়োর ছেলে কিনু বলিল,— “বাবা! আজ আর মন্দ খাইও না। বাড়ীতে আজ দুই জন ভদ্রলোক আসিবে, একটা দিন নাই খাইলে?”

 “রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,—'রাম রাম! আজি কি মদ খাইতে পারি? যাই, সকাল সকাল স্নান করিয়া আসি। তুমি জলখাবার আর রান্না-বান্নার যোগাড় করিয়া দাও।' এই বলিয়া রামেশ্বর খুড়ো স্নান করিতে গেলেন। স্নান-টান কিছুই নয়, আস্তে আস্তে গিয়া শুঁড়ির বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে দুই প্রহর পর্যন্ত বসিয়া মদ খাইতে লাগিলেন। এদিকে নাতিনীকে দেখিতে ঘরে সেই ভদ্রলোকেরা আসিয়াছেন। ‘কর্ত্তা কোথায়’ বলিয়া কিনুকে তাহারা বারবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। 'স্নান করিতে গিয়াছেন, এখনি আসিবেন’ এইরূপ বলিয়া কিনু তাহাদিগকে বুঝাইতে লাগিলেন। দুই প্রহর হইয়া গেল, রান্না প্রস্তুত, তবুও কর্ত্তার দেখা নাই। যা হইয়াছে, কিনু তাহা বুঝিলেন। বাড়ি আসিয়া পাছে ভদ্রলোকদিগের সমক্ষে ঢলঢলি করেন, সে জন্য পিতাকে সাবধান করিবার নিমিত্ত কিনু শুঁড়ির বাড়ীর দিকে চলিলেন। শ্রদ্ধাস্পদ পিতার সহিত পথে সাক্ষাৎ হইল। বগলে একবোতল মদ লইয়া টলিতে টলিতে আসিতেছেন। কিনু বলিলেন, —'বাবা! তোমার কি মান অপমানের ভয় একেবারেই গিয়াছে? তোমাতে আর কি কোনও পদার্থই নাই? এই বৃদ্ধ বয়সে তোমার কি জ্ঞানগোচর একেবারেই গিয়াছে?' রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,— 'কেন বাবা! হইয়াছে কি? এত রাগ কেন?' কিনু উত্তর করিলেন,—'হইয়াছে কি? বগলে ও কি!' রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,—'বগলে এ কি! বটে! আর কপালে এ কি? এটি দেখিলে আর ওটি বুঝি দেখিলে না।' রামেশ্বর খুড়ো শুঁড়ির বাড়ী হইতে বাহির হইয়া, পানাপুকুর হইতে একটু লইয়া কপালে একটি ফোটা কাটিয়াছিলেন। ছেলেকে সেই ফোঁটাটি দেখাইলেন। টিকি না রাখিয়া ফোঁটা কাটিলেও চলে, না চলে এমন নয়।

 আর একজন বলিলেন,— “মড়াটা যারা পোড়ায়, টিকি রাখা তাদের পক্ষে ভাল নয়। একবার একটা মড়া দানো একজনের টিকি ধরিয়াছিল। আর একটু হইলেই তাহার ঘাড়টি ভাঙ্গিয়া দিত। ভাগ্যে তাহার কোমরে একখানি কাস্তে ছিল, চট্‌ করিয়া সে কাস্তেখানি বাহির করিয়া টিকিটি কাটিয়া ফেলিল, তাই তার প্রাণ বাঁচিল।”

 আর একজন বলিলেন,—“ভাই! আমাদের মড়া যদি দানো পাইয়া থাকে? যদি গিয়া দেখি, চুলির উপর মন্দারাম গাঁটু হইয়া বসিয়া আছেন? তাহা হইলে কি হইবে?”

 সকলের মুখ শুকাইয়া গেল। তাই তো! বড় ভয়ের কথা বটে! মড়াটি দানো পাইয়া থাকুক, আর নাই থাকুক, কিন্তু চিতার উপর নাই। বোধ হয়, শৃগালে টানিয়া লইয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, উদ্ধবদাদা প্রভৃতি সকলে আসিয়া দেখিলেন যে, চিতাটি খালি পড়িয়া রহিয়াছে। চারিদিকে তাহারা মড়া খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। নিকটে একটি ঝোঁপ দেখিতে পাইয়া, একজন সেই ঝোঁপের ভিতর প্রবেশ করিলেন। গাছপানে চাহিয়াই তিনি “আঁ আঁ” করিতে করিতে বাহিরে আসিয়া ধড়াস করিয়া পড়িলেন। “কি হইয়াছে? কি হইয়াছে?” বলিয়া আর সকলে তাঁহার নিকট দৌঁড়িয়া আসিলেন। পড়িয়া পড়িয়া সে লোকটি “গোঁ-গোঁ” করিতে লাগিলেন, কোনও উত্তর করিতে পারিলেন না। মুখে-হাতে জল দিয়া সকলে তাহাকে চেতন করিলে, তিনি বলিলেন,—“ঐ গাছে!” সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“গাছে কি? গাছে কি দেখিয়াছ?” কিন্তু সে লোকটি আর কিছুই বলিতে পারেন না। “ঐ গাছে!” এই কথা সকলে উদ্ধব দাদাকে বলিলেন,— “উদ্ধব দাদা! তুমি গিয়া দেখিয়া এস, গাছে কি

১৪৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ