পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কোমর ধরিল ও লেজের আঘাতে দুই জন মাঝির প্রাণবধ করিল। নিধিরামকে কুমীরে লইয়া চলিল। একবার ডুবাইয়া পুনরায় যখন কুমীরে জলের উপর ভাসিল, তখনও নিধিরামের শরীরে প্রাণ ছিল। নিধিরামকে মুখে করিয়া কুমীর পুনরায় ডুবিল ও অল্পক্ষণ পরে নদীর তীরে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে নলের বন ছিল। নিধিরাম এক্ষণে মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন, কিন্ত তথাপি জ্ঞান ছিল। কুমীর তাঁহার কোমর ছাড়িয়া পা ধরিল। মাটির ভিতর তাহার মুখ পুতিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। এই সময়ে নিধিরাম কুমীরের দুইটি উজ্জ্বল চক্ষু দেখিতে পাইলেন। কুমীরের চক্ষুতে অঙ্গুলি দিয়া অনেকের প্রাণরক্ষা হইয়াছে, তাহার সেই কথা মনে পড়িল। কুমীরের দুইটি চক্ষুতে তিনি দুইটি অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। যাতনায় কুম্ভীর তাঁহাকে ছাড়িয়া জলে গিয়া পড়িল। কুমীরের কামড়ে নিধিরামের শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। তথাপি প্রাণের দায়ে কোনরূপে তিনি নল-বন পার হইয়া নদীর উপর গিয়া উঠিলেন। আর অধিক দূর যাইতে পারিলেন না। সেই স্থানে বসিয়া আপনার দূরদৃষ্টির বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। ভাবিলেন যে,— “হা ভগবান! আমার কপালে তুমি এত লিখিয়াছিলে? কিন্তু হিরণ্ময়ি! তোমার মত দুৰ্লভ রত্ন কি অনায়াসে লাভ হয়? তোমার জন্য, তোমার পিতার জন্য, যে আমি এই নিদারুণ ক্লেশ পাইতেছি, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই, তাহাতে আমার সুখ। এখন, একবার তোমার পিতাকে উদ্ধার করিতে পারিলে হয়!”

 নদীর উপর যে স্থানে নিধিরাম বসিয়াছিলেন, সে স্থানটি জনশূন্য প্রান্তর। নিকটে মনুষ্যের বসবাস নাই। উপরে কেবল একটি ভগ্ন কালীর মন্দির ছিল। নিকটস্থ গ্রামসমূহ হইতে লোক আসিয়া কালে-ভদ্রে এই কালীর পূজা দিয়া থাকে। উপরে মন্দির আছে, কি, কি, আছে, নিধিরাম তাহার কিছুই জানেন না। রাত্রিকাল, অন্ধকার, কি করিয়া তিনি জানিবেন? একদল ডাকাত এই রাত্রিতে কোথায় ডাকাতি করিতে যাইতেছিল। কালীর পূজা দিয়া তবে তাহারা ডাকাতি করিতে যাইবে। মহা-সমারোহে কালীর পূজা হইতেছিল। যেখানে নিধিরাম বসিয়া আছে, সেই স্থানে দুই জন ডাকাত বলি দিবার নিমিত্ত পাঠা স্নান করাইতে আনিল। নিধিরামকে দেখিতে পাইয়া ধরিল। তাহারা বলিল,— “ভাই! মা’র কি কৃপা! মা আজ আমাদের মানুষপাঁঠা মিলাইয়া দিলেন। এখন বলি, হাঁ, কালী জাগ্রত বটে! অনেককাল পরে মা'র আজ নরবলি খাইতে সাধ হইয়াছে। আজ আমাদের অনেক টাকা মিলিবে।” নিধিরাম তাহাদিগের নিকট হাত-যোড় করিয়া কত মিনতি করিলেন, কিন্তু তাহারা কিছুতেই ছাড়িল না। তাহাকে ধরিয়া তাহারা মন্দিরের সম্মুখে দলের মাঝখানে লইয়া গেল। ডাকাতের দলে আর আনন্দের পরিসীমা নাই। মা নিজে আজ নরবলির যোগাড় করিয়াছেন। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত নিধিরাম কত কি বলিলেন, কিন্তু কেহ তাঁহার কথায় কর্ণপাতও করিল না। ডাকাতদিগের পুরোহিত যথারীতি নিধিরামকে উৎসর্গ করিলেন। ডাকাতেরা তাহাকে ধরিয়া খর্পারে শোয়াইল। কেহ পায়ের দিক ধরিল, কেহ মাথার দিক ধরিল। ডাকাতদিগের সর্দার নিজে কোপ মারিবার নিমিত্ত খাড়া তুলিলেন। নিধিরাম বলপূর্ব্বক খর্পর হইতে মাথা সরাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন, আর বলিলেন,— “পাপিষ্ঠ নরাধমেরা! ব্রহ্মহত্যায় তোদের ভয় নাই?” কণ্ঠস্বর শুনিয়া ও মশালের আলোকে নিধিরামের মুখ দেখিয়া, ডাকাতদিগের সর্দ্দার খাড়া নামাইল। সর্দ্দার বলিল,— “ইহার। সর্ব্বশরীর ক্ষত-বিক্ষত, সর্ব্বশরীর হইতে ইহার রক্তধারা পড়িতেছে। মা'র নিকট এরূপ বলি কিছুতেই দেওয়া যাইতে পারে না। ইহাকে ছাড়িয়া দাও।” বিরাসবদনে ডাকাতেরা নিধিরামকে ছাড়িয়া দিল। নিধিরাম উঠিয়া দাড়াইলেন। সর্দ্দার

ভূত ও মানুষ
১৪৭