পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নিকট হইতে যাহা কিছু টাকা-কড়ি পাইত, তাহা লইত। মাঠের মাঝখানে যে-সব পুষ্করিণী আছে, তাহার ভিতর হইতে আজ পর্যন্ত মড়ার মাথা বাহির হয়। মানুষ মারিয়া দুষ্ট লোকেরা এই পুকুরের ভিতর লুকাইয়া রাখিত।

 মৃতদেহ গোপন করিবার আর একটি উপায় ছিল। পথিককে মারিয়া, মড়াটি লইয়া, দুষ্ট লোকেরা এ-গ্রাম হইতে সে-গ্রামে ফেলিয়া আসিত। অপর গ্রামে মড়াটি রাখিয়া, একপ্রকার “কুঃ” শব্দ করিয়া তাহারা চলিয়া যাইত।

 সে গ্রামের চৌকীদার সেই “কুঃ” শব্দটি শুনিয়া বুঝিতে পারিত যে, তাহার সীমানায় মড়া পড়িয়াছে। চৌকীদার ভাবিত,— “যদি আমার সীমানায় মড়া পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে কাল প্রাতঃকালে আমাকে লইয়া টানাটানি হইবে।”

 এই কথা ভাবিয়া সেও আপনার বন্ধুবর্গের সহায়তায়, মৃতদেহটি অপর গ্রামে রাখিয়া সেইরূপ “কুঃ” শব্দ করিয়া আসিত।

 এইরূপে রাতারাতি মড়াটি দশ-বার ক্রোশ দূরে গিয়া পড়িত। কোথা হইতে লোকটি আসিতেছিল, কে তাহাকে মারিল, অত দূরে আর তাহার কোনও সন্ধান হইত না।

 একে বন্য দেশ, তাহাতে আবার এইরূপ শত শত অপঘাত-মৃত্যু। সে স্থান ভূতের অভাব হইতে পারে না। অশ্বথ, বট, বেল প্রভৃতি নানা গাছে নানাপ্রকার ভূত আছে, সেখানকার লোকের এইরূপ বিশ্বাস। সন্ধ্যা হইলে, ঘরে বসিয়া, লোকে নানারূপ ভূতের গল্প করে, সেই গল্প শুনিয়া বালক-বালিকার শরীর শিহরিয়া উঠে।

 গ্রামে ডাইনীরও অপ্রতুল নাই। পিতামহী-মাতামহীগণ বালক-বালিকাদিগকে সাবধান করিয়া দেন— “ডাইনীরা পথে “কুটা” হইয়া পড়িয়া থাকে, সে তৃণ যেন মাড়াইও না, তাহা হইলে ডাইনীতে খাইবে।”

 স্থলে, সেখানকার লোকের এইরূপ পদে পদে বিপদের ভয়। জলেও কম নয়। গ্রামের একপার্শ্বে একটি নদী আছে। পাহাড় হইতে নামিয়া, “কুলকুল” করিয়া নদীটি সাগরের দিকে বহিয়া যাইতেছে। হাঙ্গর-কুম্ভীর নাই সত্য, কিন্তু নদীটি অন্য ভয়ে পরিপূর্ণ। শিকল হাতে “জটে-বুড়ি” ত' আছে-ই, তাছাড়া নদীর ভিতর জীবন্ত পাথরও অনেক। সুবিধা পাইলে এই পাথর মানুষ্যের বুকে চাপিয়া বসে। নদীর ভিতরও এইরূপ নানা বিপদের ভয়।

 কুসুমঘাটীর অনতিদূরে পর্বতশ্রেণী। পাহাড় বনে আবৃত। বনে বাঘ-ভালুক আছে। বাঘে সর্ব্বদাই লোকের গরু-বাছুর লইয়া যায়। মাঝে মাঝে এক-একটি বাঘ মনুষ্য খাইতে শিক্ষা করে। তখন সে বাঘ, মানুষ ভিন্ন আর কিছুই খায় না। লোকে উৎপীড়িত হইয়া নানা কৌশলে সে ব্যাঘ্রটিকে বধ করে।

 এক-একটি বাঘ, কিন্তু এমনি চতুর যে, কেহ তাহাকে মারিতে পারে না। লোকে বলে যে, সে প্রকৃত বাঘ নয়—সে মনুষ্য! বনে একপ্রকার শিকড় আছে, তাহা মাথায় পরিলে মনুষ্য তৎক্ষণাৎ ব্যাঘ্রের রূপ ধরিতে পারে। কাহারও সহিত কাহারও বিবাদ থাকিলে, লোকে সেই শিকড়টি মাথায় পরিয়া বাঘ হয়, বাঘ হইয়া আপনার শক্রকে বিনাশ করে। তাহার পর আবার শিকড় খুলিয়া মানুষ হয়। কেহ কেহ শিকড় খুলিয়া ফেলিতে পারে না। সে চিরকালই বাঘ থাকিয়া যায়। এই বাঘে লোকের প্রতি ভয়ানক উপদ্রব করে।

 কুসুমঘাটীর লোকের মনে এইরূপ নানাপ্রকার বিশ্বাস। কিন্তু আজকাল সকলের মন হইতে এই সব ভয় ক্রমে দূর হইতেছে। এখানকার অনেকে এখন তসরের গুটি ও গালা লইয়া কলিকাতায় আসিত। কেহ কেহ কলিকাতায় বাসা করিয়া থাকেন। কেহ কেহ অংরেজীও

ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ