পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিবাহ দিতে স্বীকৃত হইবেন। কিন্তু তাহা হইল না। হতাশ গোবিন্দ একেবারে পাগল হইয়া উঠিলেন। বলপূর্ব্বক হিরণ্ময়ীকে লইয়া বিবাহ করিবেন, তিনি এইরূপ সঙ্কল্প করিলেন। টাকা দিয়া চারি জন ইতর লোককে বশ করিলেন। পাঁচ জনে হিরণ্ময়ীকে ধরিবার নিমিত্ত সুযোগ খুঁজিতে লাগিলেন। দৈবক্রমে আজ হিরণ্ময়ী সন্ধ্যার পর একটু বাড়ীর বাহিরে আসিয়াছিলেন। সেই অবসরে পাষণ্ডেরা তাঁহাকে ধরিল ও মুখে কাপড় দিয়া মাঠের দিকে লইয়া চলিল। বাটীর লোক কি গ্রামের লোক কেহই ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিলেন না। মাঠের মাঝখানে উপস্থিত হইলে, দৈবক্রমে হিরণ্ময়ীর মুখের কাপড় একটু আলগা হইয়া গিয়াছিল। তাই তিনি একবার চীৎকার করিতে পারিয়াছিলেন। দৈবক্রমে সেই সময় নিধিরামও মাঠ দিয়া যাইতেছিলেন।

 গোবিন্দের কথা শুনিয়া নিধিরাম বুঝিলেন যে, তাহারা হিরণ্ময়ীকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে। নিমিষের মধ্যে তিনি এক ঘা লাঠি মারিয়া দুইটি লোককে ভূতলশায়ী করিলেন। বাকি তিনজন হিরণ্ময়ীকে ছাড়িয়া নিধিরামের উপর লাঠি-বর্ষণ করিতে লাগিল। “কে কোথা আছে গো! এস গো! ওগো, এখানে সর্ব্বনাশ হয় গো|” এই বলিয়া হিরণ্ময়ী চীৎকার করিতে লাগিলেন। দূর হইতে কে শব্দ করিল,—“যাই, যাই, ভয় নাই।” এইরূপ শব্দ শুনিয়া গোবিন্দ ও তাহার সঙ্গিগণ পলাইল। নিধিরামের লাঠিতে যে দুই জন প্রথমেই মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারাও উঠিয়া পলাইল।

 গোবিন্দ ও তাহার সঙ্গিগণ যখন পলাইয়া গেল, তখন হিরণ্ময়ী দেখিলেন যে, নিধিরাম মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছেন। তাড়াতাড়ি হিরন্ময়ী গিয়া তাঁহার মাথাটি তুলিয়া ধরিলেন। দেখিলেন, তাঁহার জ্ঞান নাই, সর্ব্বশরীরে রক্তে প্লাবিত হইতেছে। কাঁদিতে কাঁদিতে হিরণ্ময়ী তাঁহাকে ডাকিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে দূর যে লোকটি সাড়া দিয়াছিলেন, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িতে দৌড়িতে আসিয়া সেই স্থলে উপস্থিত হইলেন। তিনি অতি সুন্দর যুবাপুরুষ আর কেহ নয়, জয়দেবপুরের ধনবান কুলীনের ছেলে নবীন, যাহার মাতুলাশ্রয় চণ্ডীপুরে, যাহার সহিত হিরণ্ময়ীর বিবাহের কথা হইয়াছিল। নবীন আসিয়া উপস্থিত হইলে, হিরণ্ময়ী কাঁদিতে কাঁদিতে দুই-চারি কথায় তাহাকে ঘটনার বিষয় বলিলেন। নিধিরামের নাকে মুখে বুকে হাত দিয়া নবীন বলিলেন,— “বোধ হয়, ইনি এখনও জীবিত আছেন। কিন্তু অতি শীঘ্র ইহাকে গ্রামে লইয়া যাইতে হইবে। আমরা দুই জনে এত পথ লইয়া যাইতে পারিব না। রও, আমি লোক ডাকি।” এই বলিয়া নবীন চীৎকার করিয়া লোক ডাকিতে লাগিলেন।

 সন্ধ্যাবেলা হিরণ্ময়ী বাহিরে গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর ক্রমে অন্ধকার হইয়া আসিল, তথাপি হিরণ্ময়ী ফিরিয়া আসিলেন না। এককড়ি ও তাঁহার গৃহিণী প্রথমে বাড়ীর আশেপাশে খুঁজিয়া দেখিলেন, কিন্তু তাঁহাকে পাইলেন না। কত ডাকিলেন, কিন্তু কোনও উত্তর পাইলেন না। মহা ভাবনা উপস্থিত হইল। প্রতিবাসিগণ চারিদিকে হিরণ্ময়ীকে খুঁজিতে দৌড়িল। যাহারা মাঠের দিকে খুঁজিতে আসিয়াছিলেন, তাহারা নবীনের চীৎকার শব্দ শুনিতে পাইল। যে স্থানে ভূতলশায়ী নিধিরামকে লইয়া হিরণ্ময়ী ও নবীন ছিলেন, সেই স্থানে আসিয়া তাহারা উপস্থিত হইল। ঘটনার বিষয় সকলে অবগত হইয়া ধরাধরি করিয়া মুমূর্ষ নিধিরামকে এককড়ির বাড়ীতে লইয়া গেল। প্রদীপ আনিয়া সকলে দেখিল যে, নিধিরামের আর কিছু বাকী নাই। বক্ষঃস্থলে প্রাণটুকু কেবল অল্পমাত্র ধুকধুক্‌ করিতেছে। মস্তক দুই-চারি স্থানে ফাটিয়া গিয়াছে, একটি চক্ষু বাহির হইয়া পড়িয়াছে, নাসিকা একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, দুই পাটি দন্ত

১৫০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ