পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দুঃখ বলিয়া ভাবেন, চিরকাল তাঁহাকে দরিদ্র থাকিতে হয়।

 খেতুর যখন চারি বৎসর বয়স, তখন হঠাৎ তাহার পিতার মৃত্যু হইল। স্ত্রী ও শিশুসন্তানটিকে একেবারে পথে দাঁড় করাইয়া গেলেন। খেতুর বাপ অনেকের উপকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখন বড়লোক হইয়াছেন। কিন্তু এই বিপদের সময় কেহই একবার উঁকি মারিলেন না। কেহই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না যে,— “খেতুর মা! তোমার হবিষ্যের সংস্থান আছে কি না?”

 এই দুঃখের সময় কেবল রামহরি মুখোপাধ্যায় ইহাদের সহায় হইলেন।

 রামহরি ইহাদের জ্ঞাতি, কিন্তু দূর-সম্পর্ক। খেতুর বাপ, তাহার একটি সামান্য চাকরি করিয়া দিয়াছিলেন। দেশে অভিভাবক নাই, সে জন্য কলিকাতায় তাঁহাকে পরিবার লইয়া থাকিতে হইয়াছে। যে কয়টি টাকা পান, তাহাতেই কষ্টে-সৃষ্টে দিনপাত করেন।

 তিনি কোথায় পাইবেন? তবুও যাহা কিছু পারিলেন, বিধবাকে দিলেন ও চাঁদার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেন। খেতুর বাপের খাইয়া যাহারা মানুষ, আজ তাহারা রামহরিকে কতই না ওজারআপত্তি অপমানের কথা বলিয়া দুই-এক টাকা চাঁদা দিল। তাহাতেই খেতুর বাপের তিল-কাঞ্চন করিয়া শ্রাদ্ধ হইল। চাঁদার টাকা হইতে যাহা কিছু বঁচিল, রামহরি তাহা দিয়া খেতুর মা ও খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিলেন।

 দেশে পাঠাইয়া দুঃখিনী বিধবাকে তিনি চাউলের দামটি দিতেন; অধিক আর কিছু দিতে পারিতেন না। ব্রাহ্মণী পৈতা কাটিয়া কোনওমতে কুলান করিতেন। দেশে বান্ধব কেহই ছিল না। নিরঞ্জন কবিরত্ন কেবলমাত্র দেখিতেন-শুনিতেন; বিপদে-আপদে তিনিই বুক দিয়া পড়িতেন।

 খেতুর মা'র এইরূপে কষ্টে দিন কাটিতে লাগিল। ছেলেটি শান্ত সুবোধ, অথচ সাহসী ও বিক্রমশীল হইতে লাগিল। তাহার রূপ-গুণে স্নেহ-মমতায় মা সকল দুঃখ ভুলিতেন। ছেলেটি যখন সাত বৎসরের হইল, তখন রামহরি দেশে আসিলেন।

 খেতুর মাকে তিনি বলিলেন,— “খেতুর এখন লেখা-পড়া শিখিবার সময় হইল, আর ইহাকে এখানে রাখা হইবে না। আমি ইহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি। আপনার কি মত?”

 খেতুর মা বলিলেন,— “বাপ রে! তা কি কখন হয়? খেতুকে ছাড়িয়া আমি কি করিয়া থাকিব? নিমিষের নিমিত্তও খেতুকে চক্ষুর আড় করিয়া আমি জীবিত থাকিতে পারিব না। না বাছা! এ প্রাণ থাকিতে আমি খেতুকে কোথাও পাঠাইতে পারিব না।”

 রামহরি বলিলেন, — “দেখুন, এখানে থাকিলে খেতুর লেখাপড়া হইবে না। মথুর চক্রবর্ত্তীর অবস্থা কি ছিল জানেন তো? গাজনের শিবপূজা করিয়া অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করিত। 'গাজুনে বামুন' বলিয়া সকলে তাঁহাকে ঘৃণা করিত। তাহার ছেলে ষাঁড়েশ্বর আপনার বাসায় দিনকতক রাঁধুনী বামুন থাকে। অল্পবয়স্ক বালক দেখিয়া শিবকাকার দয়া হয়, তিনি তাহাকে স্কুলে দেন। এখন সে উকীল হইয়াছে। এখন সে একজন বড়লোক।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “চুপ কর! কলিকাতায় লেখা-পড়া শিখিয়া যদি ষাড়েশ্বরের মত হয়, তাহা হইলে আমার খেতুর লেখা-পড়া শিখায় কাজ নাই।”

 রামহরি বলিলেন,— “সত্য বটে, ষাড়েশ্বর মদ খায়, আর মুসলমান সহিসের হাতে নানারূপ অখাদ্য মাংসও খায়, আবার এদিকে প্রতিদিন হরি-সঙ্কীর্ত্তন করে। কিন্তু তা বলিয়া কি সকলেই সেইরূপ হয়? পুরুষমানুষে লেখা-পড়া না শিখিলে কি চলে? পুরুষমানুষের যেরূপ

ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ