পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বঁচিয়া থাকার প্রার্থনা, বিদ্যাশিক্ষারও সেইরূপ প্রার্থনা।”

 খেতুর মা বলিলেন, — “হাঁ সত্যকথা। পুত্রের যেরূপ বাঁচিবার প্রার্থনা, বিদ্যার প্রার্থনাও তাহার চেয়ে অধিক। যে মাতা-পিতা ছেলেকে বিদ্যাশিক্ষা না দেন, সে মাতা-পিতা ছেলের পরম-শত্রু। তবে বুঝিয়া দেখ, আমার মার প্রাণ, আমি অনাথিনী সহায়হীনা বিধবা। পৃথিবীতে আমার কেহ নাই, এই একরতি ছেলেটিকে লইয়া সংসারে আছি। খেতুকে আমি নিমিষে হারাই। খেলা করিয়া ঘরে আসিতে খেতুর একটু বিলম্ব হইলে, আমি যে কত কি কু ভাবি, তাহা আর কি বলিব? ভাবি, খেতু বুঝি জলে ডুবিল, খেতু বুঝি আগুনে পুড়িল, খেতু বুঝি গাছ হইতে পড়িয়া গেল, খেতুকে বুঝি পাড়ার ছেলেরা মারিল! খেতু যখন ঘুমায়, রাত্রিতে উঠিয়া উঠিয়া আমি খেতুর নাকে হাত দিয়া দেখি,— খেতুর নিশ্বাস পড়িতেছে কি না? ভাবিয়া দেখ দেখি, এ দুধের বাছাকে দূরে পাঠাইতে মার মহাপ্রাণী কি করে? তাই কাঁদি, তাই বলি 'না'।” পুনরায় খেতুর মা বলিলেন,— “রামহরি! খেতু আমার বড় গুণের ছেলে। কেবল দুই বৎসর পাঠশালায় যাইতেছে, ইহার মধ্যেই তালপাতা শেষ করিয়াছে, কলাপাতা ধরিয়াছে।” গুরু মহাশয় বলেন, — “খেতু সকলের চেয়ে ভাল ছেলে।”

 “আর দেখ রামহরি! খেতু আমার অতি সুবোধ ছেলে। খেতুকে আমি যা করিতে বলি, খেতু তাই করে। যেটি মানা করি, সেটি আর খেতু করে না। একদিন দাসেন্দের মেয়ে আসিয়া বলিল,— ‘ওগো তোমার খেতুকে পাড়ার ছেলেরা বড় মারিতেছে।' আমি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলাম। দেখিলাম, ছয়জন ছেলে একা খেতুর উপর পড়িয়াছে। খেতুর মনে ভয় নাই, মুখে কান্না নাই। আমি দৌঁড়িয়া গিয়া খেতুকে কোলে লইলাম। খেতু তখন চক্ষু মুছিতে মুছিতে বলিল — ‘মা! আমি উহাদের সাক্ষাতে কাঁদি নাই, পাছে উহারা মনে করে যে, আমি ভয় পাইয়াছি। একা একা আমার সঙ্গে কেহই পারে না! উহারা ছয়জন, আমি একা, তা আমিও মারিয়াছি। আবার যখন একা একা পাইব, তখন আমিও ছয়জনকে খুব মারিব।' আমি বলিলাম,— 'না বাছা! তা করিতে নাই। প্রতিদিন যদি সকলের সঙ্গে মারামারি করিবে, তবে খেলা করিবে কার সঙ্গে?' খেতু আমার কথা শুনিল। কত দিন সে ছেলেদের খেতু একলা পাইয়াছিল, মনে করিলে খুব মারিতে পারিত; কিন্তু আমি মানা করিয়াছিলাম বলিয়া কাহাকেও সে আর মারে নাই।”

 আর একদিন আমি খেতুকে বলিলাম,— “খেতু! তনু রায়ের আঁবগাছে ঢিল মারিও না। তনু রায় খিটখিটে লোক, সে গালি দিবে।” খেতু বলিল,— 'মা। ও-গাছের আঁব বড় মিষ্ট গো! একটি আঁব পাকিয়া টুকটুক করিতেছিল। আমার হাতে একটি টিল ছিল। তাই মনে করিলাম, দেখি, পড়ে কি না?' আমি বলিলাম,— “বাছা! ও গাছের আঁব বড় মিষ্ট হইলে কি হইবে, ও গাছটি তো আর আমাদের নয়? পরের গাছে ঢিল মারিলে, যাদের গাছ, তাহারা রাগ করে; যখন আপনা-আপনি তলায় পড়িবে, তখন কুড়াইয়া খাইও, তাহাতে কেহ কিছু বলিবে না।”

 তাহার পর, আর একদিন খেতু আমাকে আসিয়া বলিল,— মা! জেলেদের গাবগাছে খুব গাব পাকিয়াছে। পাড়ার ছেলেরা সকলে গাছে উঠিয়া গাব খাইতেছিল। আমাকে তাহারা বলিল,— “খেতু! আয় না ভাই! দুরের গাব যে আমরা পাড়িতে পারি না! তা মা আমি গাছে উঠি নাই। গাবগাছটি তো, মা! আর আমাদের নয়, যে উঠিব? আমি তলায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। ছেলেরা দুটি-একটি গাব আমাকে ফেলিয়া দিল। মা! সে গাব কত যে গো মিষ্ট, তাহা আর তোমাকে কি বলিব! তোমার জন্য একটি গাব আনিয়াছি, তুমি বরং, মা! খাইয়া দেখ! মা! আমাদের যদি একটি গাবগাছ থাকিত, তাহা হইলে বেশ হইত।” আমি বলিলাম,— 'খেতু! বুড়োমানুষে গাব খায় না, ও গাবটি তুমি খাও। আর পরের গাছে পাকা গাব পাড়িতে

কঙ্কাবতী