পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জনার্দ্দন চৌধুরী কাগজখানি হাতে লইয়া বলিলেন,— “হা, এই কাগজখানি বটে, ইহা আমি পূর্ব্বে দেখিয়াছি, এখন আর দেখিবার আবশ্যক নাই।”

 এই কথা বলিয়া নিরঞ্জনের হাতে তিনি কাগজখানি ফিরাইয়া দিলেন। নিরঞ্জন কাগজখানি তামাক খাইবার আগুনের মালসায় ফেলিয়া দিলেন। দেখিতে দেখিতে কাগজখানি জ্বলিয়া গেল।

 জমিদার বলিলেন,— “হাঁ-হাঁ! করেন কি?”

 নিরঞ্জন বলিলেন,— “কেবল পাঁচ বিঘা কেন? আজ হইতে আমার সমুদায় ব্রহ্মোত্তর ভূমি আপনার। যিনি জীব দিয়াছেন, নিরঞ্জনকে তিনি আহার দিবেন।”

 পাছে ব্রহ্মশাপে পড়েন, সে জন্য জনার্দ্দন চৌধুরীর ভয় হইল।

 তিনি বলিলেন,— “দলিল গিয়াছে গিয়াছে, তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই। আপনি ভূমি ভোগ করুন, আপনাকে আমি কিছু বলিব না।”

 নিরঞ্জন উত্তর করিলেন, — “না মহাশয়! জীব যিনি দিয়াছেন, আহার তিনি দিবেন। সেই দীনবন্ধুকে ধ্যান করিয়া তাহার প্রতি জীবন সমর্পণ করিয়া কালাতিপাত করাই ভাল। বিষয়বৈভবচিন্তা যদি ধর্ম্মানুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটে, চিত্ত যদি বিচলিত হয় তাহা হইলে সে বিষয়-বিভব পরিত্যাগ করাই ভাল। আমার ভূমি ছিল বলিয়াই তো আজ দুইপ্রহরের সময় আপনার যবনপেয়াদার নিষ্ঠুর বচন আমাকে শুনিতে হইল? সুতরাং সে ভূমিতে আর আমার কাজ নাই। স্পহাশূন্য ব্যক্তির নিকট রাজা, ধনী, নির্ধন, সবাই সমান। আপনি বিষয়ী লোক, আপনি আমার কথা বুঝিতে পরিবেন না। বুঝিতে পারিলেও আপনি সংসার-বন্ধনে নিতান্ত আবদ্ধ। মরীচিকামায়াজালের অনুসরণ আপনাকে করিতেই হইবে। আতপ-তাপিত ভূষিত মরুপ্রান্তর হইতে আপনি মুক্ত হইতে পরিবেন না। এখন আশীর্ব্বাদ করুন, যেন কখনও কাহারও নিকট কোন বিষয়ের নিমিত্ত নিজের জন্য আমাকে প্রার্থী হইতে হয়।”

 এই কথা বলিয়া নিরঞ্জন প্রস্থান করিলেন।

 নিরঞ্জনের সেইদিন হইতে মন্দ হইল। অতিকষ্টে তিনি দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ছাত্রগণ একে একে তাঁহাকে ছাড়িয়া গোবর্দ্ধন শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে যাইল।

 গোবর্দ্ধন শিরোমণি জনার্দ্দন চৌধুরীর সভাপণ্ডিত; অনেকগুলি ছাত্রকে তিনি অন্নদান করেন। বিদ্যাদান করিবার তাহার অবকাশ নাই। চৌধুরী মহাশয়ের বাটীতে সকাল-সন্ধ্যা উপস্থিত থাকিতে হয়, তাহা ব্যতীত অধ্যাপকের নিমন্ত্রণে সর্ব্বদা তাঁহাকে নানা স্থানে গমনাগমন করিতে হয়। সুতরাং ছাত্রগণ আপনা-আপনি বিদ্যাশিক্ষা করে।

 সেজন্য কিন্তু কেহ দুঃখিত নয়। গোবর্দ্ধন শিরোমণির উপর রাগ হয় না, অভিমানও হয় না। কারণ, তিনি অতি মধুরভাষী, বাক্যসুধা দান করিয়া সকলকেই পরিতুষ্ট করেন। বিশেষতঃ ধনবান লোক পাইলে শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় তিনি বাক্যসুধা বর্ষণ করিতে থাকেন; ভূষিত চাতকের ন্যায় তাহারা সেই সুধা পান করেন।

 একদিন জনার্দ্দন চৌধুরীর বাটীতে আসিয়া তনু রায় শাস্ত্রবিচার করিতেছিলেন। নিরঞ্জন, গোবর্দ্ধন প্রভৃতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

 তনু রায় বলিলেন, — “কন্যাদান করিয়া বংশজ কিঞ্চিৎ সম্মান গ্রহণ করিবে। শাস্ত্রে ইহার বিধি আছে।”

 নিরঞ্জন জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কোন শাস্ত্রে আছে? এরূপ শুল্কগ্রহণ করা তো ধর্ম্মশাস্ত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ।”

১২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ