পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তুমি এখন বড় হইয়াছ, এইবার তোমাকে স্কুলে পড়িতে হইবে। না পড়িলে-শুনিলে মূর্খ হয়। মূর্খকে কেহ ভালবাসে না, কেহ আদর করে না। তুমি যদি স্কুলে যাও আর মন দিয়া লেখাপড়া কর, তাহা হইলে সকলেই তোমাকে ভালবাসিবে। আর খেতু! তোমার এই দুঃখিনী মার দুঃখ ঘুচিবে। এই দেখ, আমি আর সরু পৈতা কাটিতে পারি না, চক্ষে দেখিতে পাই না। আর কিছুদিন পরে হয়তো মোটা পৈতাও কাটিতে পারিব না। তখন বল, পয়সা কোথায় পাইব? লেখাপড়া শিখিয়া তুমি টাকা আনিতে পারিলে, আমাকে আর পৈতা কাটিতে হইবে না। আমি তখন সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকিব, পূজা-আচ্ছা করিব, আর ঠাকুরদের কাছে বলিব,— খেতু আমার বড় সুছেলে, খেতুকে তোমরা বাঁচাইয়া রাখ।”

 খেতু বলিলেন, — “মা। আমি যদি যাই, তুমি কাঁদিবে না?”

 মা উত্তর করিলেন,— “না বাছা, কাঁদিব না।

 খেতু বলিলেন, — “ঐ যে মা! কাঁদিতেছ?”

 মা উত্তর করিলেন,— “এখন কান্না পাইতেছে, ইহার পর আর কাঁদিব না। আর খেতু! সেখানে তোমাকে বারমাস থাকিতে হইবে না, ছুটি পাইলে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ী আসিবে। আমি পথপানে চাহিয়া থাকিব, আগে থাকিতে দত্তদের পুকুরধারে গিয়া বসিয়া থাকিব, সেইখান হইতে তোমাকে কোলে করিয়া আনিব। মন দিয়া লেখাপড়া করিলে, তুমি আবার আমাকে চিঠি লিখিতে শিখিবে। তুমি আমাকে কত চিঠি লিখিবে আমি সে চিঠিগুলি তুলিয়া রাখিব, কাহাকেও খুলিতে দিব না, কাহাকেও পড়িতে দিব না। তুমি যখন বাড়ীতে আসিবে, তখন সেই চিঠিগুলি খুলিয়া আমাকে পড়িয়া পড়িয়া শুনাইবে।”

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন, — “মা! সেখানে মালা পাওয়া যায়?”

 মা বলিলেন,— “মালা কি?”

 মা উত্তর করিলেন,— “হাঁ বাছা! মালা সেখানে অনেক পাওয়া যায়।”

 খেতু বলিলেন,— “আমি তোমার জন্য, মা! ভাল মালা কিনিয়া আনিব।”

 মা উত্তর করিলেন,— “তাই ভাল! আমার জন্য মালা আনিও।”

 মাতা-পুত্রে এইরূপ কথার পর, কলিকাতার বিষয় ভাবিতে ভাবিতে খেতু নিদ্রিত হইলেন। তাহার পরদিন সকালে উঠিয়া খেতু বলিলেন,— “মা, এই কয়দিন আমি পাঠশালায় যাইব না, খেলা করিতেও যাইব না, সমস্ত দিন তোমার কাছে থাকিব।”

 মা উত্তর করিলেন,— “আচ্ছা, তাই ভাল, তবে তোমার নিরঞ্জন কাকাকে একবার নমস্কার করিতে যাইও।”

 খেতু বলিলেন,— “তা যাব। আমি আর একটি কথা বলি। তোমার খাওয়া হইলে, এ কয়দিন আমি তোমার পাতে ভাত খাইব। পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, কেন তা জান মা? যাহা তোমার মুখে ভাল লাগে, নিজে না খাইয়া আমার জন্য রাখ। তাই আমি বলি, 'দুপুরবেলা, মা! আমার ক্ষুধা পায় না, আমার জন্য পাতে ভাত রাখিও না।' ক্ষুধা, কিন্তু মা! খুব পায়। লোকের গাছতলায় কত কুল, কত বেল পড়িয়া থাকে, স্বচ্ছন্দে কুড়াইয়া খাই। কিন্তু তোমার ক্ষুধা পাইলে তুমি তো মা, তা খাও না? তাই পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, পাছে মা! তোমার পেট না ভরে।

 ব্রাহ্মণী খেতুকে কোলে লইলেন, মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কঁদিতে লাগিলেন, আর

১৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ