পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 যতক্ষণ দেখা যাইল, ততক্ষণ খেতুর মা অনিমিষ-নয়নে সেই পথপানে চাহিয়া রহিলেন। খেতুও মাঝে মাঝে পশ্চাৎদিকে চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। যখন আর দেখা গেল না, তখন খেতুর মা পথের ধুলায় শুইয়া পড়িলেন। ধূলায় লুষ্ঠিত হইয়া অবিরল ধারায় চক্ষের জলে সেই ধূলা ভিজাইতে লাগিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

কঙ্কাবতী

পথে পড়িয়া খেতুর মা কঁদিতেছেন, এমন সময় তনু রায়ের স্ত্রী সেইখানে আসিলেন।

 তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে তিনি বলিলেন,— “দিদি! চুপ কর। চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিলে ছেলের অমঙ্গল হয়।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “সব জানি বোন! কিন্তু কি করি? চক্ষের জল যে রাখিতে পারি না, আপনা-আপনি বাহির হইয়া পড়ে। আমি যে আজ পৃথিবী শূন্য দেখিতেছি! কি করিয়া যে ঘরে যাই? আজ যে আমার আর কোন কাজ নাই। আজ তো আর খেতু পাঠশালা হইতে কালি-ঝুলি মাখিয়া ক্ষুধা ক্ষুধা করিয়া আসিবে না? এতক্ষণ খেতু কতদূর চলিয়া গেল! আহা, বাছার কত না মন-কেমন করিতেছে!

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “চল আহা! খেতু কি গুণের ছেলে! দেশে তবেই তা না হইলে সব বৃথা।”

 এই বলিয়া তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর-মার হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া দুইজনে খেতুর গল্প করিলেন।

 খেতু খাইয়া গিয়াছিল, তনু রায়ের স্ত্রী সেই বাসনগুলি মাজিলেন ও ঘর-দ্বার সব পরিষ্কার করিয়া দিলেন। বেলা হইলে খেতুর মা রাঁধিয়া খাইবেন, সে নিমিত্ত তরকারিগুলি কুটিয়া দিলেন, বাটনটুকু বাটিয়া দিলেন।

 খেতুর মা বলিলেন,— “থাক বোন থাকা! আজ আর আমার খাওয়া-দাওয়া! আজ আর আমি কিছু খাইব না।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “না দিদি! উপবাসী কি থাকিতে আছে? খেতুর অকল্যাণ হইবে।”

 “খেতুর অকল্যাণ হইবে।” এই কথাটি বলিলেই খেতুর মা চুপ! যা’ করিলে খেতুর অকল্যাণ হয়, তা’ কি তিনি করিতে পারেন?

 তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,— “এই সব ঠিক করিয়া দিলাম। বেলা হইলে রান্না চড়াইয়া দিও। কাজ-কর্ম্ম সারা হইলে আমি আবার ও-বেলা আসিব।”

 অপরাহে তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় আসিলেন। কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন।

১৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ