পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 খেতুর মা বলিলেন,— “আহা! কি সুন্দর মেয়েটি বোন! যেমন মুখ, তেমনি চুল, তেমনি রং।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “হাঁ! সকলেই বলে, এ কন্যাটি তোমার গর্ভের সুন্দর। তা দিদি! এ পোড়া পেটে কেন যে এরা আসে? মেয়ে হইলে ঘরের মানুষটি আহ্লাদে আটখানা হন; কিন্তু আমার মনে হয় যে, আঁতুর ঘরেই মুখে লুণ দিয়া মারি। গ্রীষ্মকালে একাদশীর দিন, মেয়ে দুইটির যখন মুখ শুকাইয়া যায়, যখন একটু জলের জন্য বাছাদের প্রাণ টা-টা করে, বল দেখি, দিদি! মার প্রাণ তখন কিরূপ হয়? পোড়া নিয়ম! যে এ নিয়ম করিয়াছে, তাহাকে যদি একবার দেখিতে পাই, তো ঝাঁটাপেটা করি। মুখপোড়া যদি একটু জল খাবারও বিধান দিত, তাহা হইলে কিছু বলিতাম না!”

 খেতুর মা বলিলেন,— “আর-জন্মে যে যেমন করিয়াছে, এ-জন্মে সে তার ফল পাইয়াছে; আবার এ-জন্মে যে যেরূপ করিবে, ফিরে-জন্মে সে তার ফল পাইবে।”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “তা বটে! কিন্তু মার প্রাণ কি সে কথায় প্রবোধ মানে গা?”

 তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,— “এক একবার মনে হয় যে, যদি বিদ্যাসাগরী মতটা চলে, তো ঠাকুরদের সিন্নি দিই।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “চুপ কর বোন! ছিঃ। ছিঃ! ও কথা মুখে আনিও না! বিদ্যাসাগরের কথা শুনিয়া সাহেবরা যদি বলেন যে, দেশে আর বিধবা থাকিতে পারে না, সকলেই বিবাহ করিতে হইবে, ছি ছি! ও মা! কি ঘৃণার কথা! এই বৃদ্ধ বয়সে তাহা হইলে যাব কোথা? কাজেই তখন গলায় দড়ি দিয়া কি জলে ডুবিয়া মরিতে হইবে!”

 তনু রায়ের স্ত্রী হাসিয়া বলিলেন,— “দিল্লি তুমি কলিকাতায় ছিলে, কিন্তু তুমি কিছু জান না। বিদ্যাসাগর মহাশয় বুড়োহাবড়া সকলেই ধরিয়া বিবাহ দিতে চান নাই। অতি অল্পবয়সে যাহারা বিধবা হয়, কেবল সেই বালিকাদিগের বিবাহের কথা তিনি বলিয়া ছিলেন। তাও যাহার ইচ্ছা হবে, সে দিবে; যাহার ইচ্ছা না হবে, না দিবে।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “কি জানি, ভাই। আমি অতশত জানি না।”

 তনু রায়ের স্ত্রীর দুইটি বিধবা মেয়ে, তাহাদের দুঃখে তিনি সদাই কাতর। সেজন্য বিধবাবিবাহের কথা পড়িলে তিনি কান দিয়া শুনিতেন। কলিকাতায় বাস করিয়া খেতুর মা যাহা না জানেন, তাহা ইনি জানেন।

 তনু রায় পণ্ডিত লোক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতটি যেই বাহির হইল, আর ইনি লুফিয়া লইলেন।

 তিনি বলিলেন,— “বিধবা-বিবাহের বিধি যদি শাস্ত্রে আছে, তবে তোমরা মানিবে না কেন? শাস্ত্র অমান্য করা ঘোর পাপের কথা। দুইবার কেন? বিধবাদিগের দশবার বিবাহ দিলেও কোন দোষ নাই, বরং পুণ্য আছে। কিন্তু এ হতভাগ্য দেশ ঘোর কুসংস্কারে পরিপূর্ণ, এ-দেশের আর মঙ্গল নাই।”

 তনু রায়ের মত নিষ্ঠাবান লোকের মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া প্রথম প্রথম সকলে কিছু আশ্চর্য্য হইয়াছিল। তারপর সকলে ভাবিল,— “আহা। বাপের প্রাণ। ঘরে দুইটি বিধবা মেয়ে, মনের খেদে উনি এইরূপ কথা বলিতেছেন।”

 কেবল নিরঞ্জন বলিলেন,— “হা, বিধবা-বিবাহটি প্রচলিত হইলে তনু রায়ের ব্যবসাটি চলে ভাল!"

কঙ্কাবতী
১৭