পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লোককে চাহিয়া দেখিতে হয়, বার বার দেখিয়াও আশা মিটে না। সমবয়স্ক বালিকাদিগের সহিত কঙ্কাবতী যখন দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করেন, তখন যথার্থই যেন বিজলী খেলিয়া বেড়ায়!

 এখন কঙ্কাবতীর বয়স হইয়াছে। এখন কঙ্কাবতী সেরূপ আর দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলিয়া বেড়ান না। তবে কি জন্য একদিন একটু ছুটিয়া বাড়ী আসিয়াছিলেন। শ্রমে মুখ ঈষৎ রক্তবর্ণ হইয়াছে, গাল দিয়া সেই রক্তিমা আভা যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছে, সমস্ত মুখ টলটল করিতেছে, জগতে কঙ্কাবতীর রূপ তখন আর ধরে না।

 মা, তাহা দেখিয়া, তনু রায়কে বলিলেন,— “তোমার মেয়ের পানে একবার চাহিয়া দেখ! এ সোনার প্রতিমাকে তুমি জলাঞ্জলি দিও না। কঙ্কাবতী স্বয়ং লক্ষ্মী। এমন সুলক্ষণা মেয়ে জনমে কি কখনও দেখিয়াছ? মা যদি এই অভাগা কুটীরে আসিয়াছেন, তো, মাকে অনাস্থা করিও না। মা যেরূপ লক্ষ্মী, সেইরূপ নারায়ণ দেখিয়া মা'র বিবাহ দিও। এবার আমার কথা শুনিও।”

 তনু রায় কঙ্কাবতীর পানে একটু চাহিয়া দেখিলেন, দেখিয়া চকিত হইলেন। তনু রায়ের মন কখনও এরূপ চকিত হয় নাই। তনু রায় ভাবিলেন,— “এ কি? একেই বুঝি লোকে অপত্যস্নেহ বলে?”

 স্ত্রীর কথায় তনু রায় কোনও উত্তর করিলেন না।

 আর একদিন তনু রায়ের স্ত্রী স্বামীকে বলিলেন,— “দেখ, কঙ্কাবতীর বিবাহের সময় উপস্থিত হইল। আমার একটি কথা তোমাকে রাখিতে হইবে। ভাল, মনুষ্য-জীবনে তো আমার একটি সাধও পূর্ণ কর!”

 তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি তোমার সাধ?”

 স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “আমার সাধ এই যে, ঝি জামাই লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করি। দুই মেয়ের তুমি বিবাহ দিলে, আমার সাধ পূর্ণ হইল না, দিবারাত্রি ঘোর দুঃখের কারণ হইল। যা হউক, সে যা হইবার তা হইয়াছে; এখন কঙ্কাবতীকে একটি ভাল বর দেখিয়া বিবাহ দাও। মেয়ে দুইটি বলে যে, আমাদের কপালে যা ছিল, তা হইয়াছে, এখন ছোট বোনটিকে সুখী দেখিলে আমরা সুখী হই।”

 স্ত্রী বল, পুত্র বল, কন্যা বল, টাকার চেয়ে তনু রায়ের কেহই প্রিয় নয়। তথাপি, কঙ্কাবতীর কথা মনে পড়িলে, তাহার মন কিরূপ করে। সে কি মমতা, না আতঙ্ক? দেবীরূপী কঙ্কাবতীকে সহসা বিসৰ্জ্জন দিতে তাহার সাহস হয় না। এদিকে দুরন্ত অর্থলোভও অজেয়। ত্রিভুবনমোহিনী কন্যাকে বেচিয়া তিনি বিপুল অর্থলাভ করিবেন, চিরকাল এই আশা করিয়া আছেন। আজ সে আশা কি করিয়া সমূলে কাটিয়া ফেলেন? তনু রায়ের মনে আজ দুই ভাব। এরূপ সঙ্কটে তিনি আর কখনও পড়েন নাই।

 কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তনু রায় বলিলেন,— “আচ্ছা! আমি না হয়, কঙ্কাবতীর বিবাহ দিয়া টাকা না লইলাম! কিন্তু ঘর হইতে টাকা তো আর দিতে পারিব না? আজকাল যেরূপ বাজার পড়িয়াছে, টাকা না দিলে সুপাত্র মিলে না। তার কি করিব?”

 স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “আচ্ছা! আমি যদি বিনা টাকায় সুপাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারি, তুমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে কি না, তা আমাকে বল?”

 তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কোথায়? কে?”

 স্ত্রী বলিলেন,— “বৃদ্ধ হইলে চক্ষুর দোষ হয়, বুদ্ধি-শুদ্ধি লোপ হয়। চক্ষুর উপর দেখিয়াও

কঙ্কাবতী
২৭