পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিলেন। স্বামীর নিকট রাত্রি-দিন কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন।

 এদিকে তনু রায়ও কিছু চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, “আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। দুইটি বিধবা গলায়, পুত্রটি মূর্খ। এখন একটি অভিভাবকের প্রয়োজন। খেতু যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করিতেছে, খেতু যেরূপ সুবোধ, তাহাতে পরে তাহার নিশ্চয় ভাল হইবে। আমাকে সে একেবারে এখন কিছু না দিতে পারে, না পারুক; পরে, মাসে মাসে আমি তাহার নিকট হইতে কিছু কিছু লইব।”

 এইরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন,— “তুমি যদি খেতুর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ স্থির করিতে পার, তাহাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি খরচপত্র কিছু করিতে পারিব না।”

 এইরূপ অনুমতি পাইয়া তনু রায়ের স্ত্রী, তৎক্ষণাৎ খেতুর মা'র নিকট দৌড়িয়া যাইলেন, আর খেতুর মা'র পায়ের ধুলা লইয়া তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন।

 খেতুর মা বলিলেন,— “কষ্কাবতী আমার বৌ হইবে, চিরকাল আমার এই সাধ। কিন্তু বোন! দুই দিন আগে যদি বলিতে? অন্য স্থানে কথা স্থির করিতে আমি রামহরিকে চিঠি লিখিয়াছি। রামহরি যদি কোন স্থানে কথা দিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কথা আর নড়িবার নয়। তাই আমার মনে বড় ভয় হইতেছে।”

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,— “দিদি। যখন তোমার মত আছে, তখন নিশ্চয় কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হইবে। তুমি একখানি চিঠি লিখিয়া রাখ। চিঠিখানি লোক দিয়া পঠাইয়া দিব।”

 তাহার পরদিন খেতুর মা ও কঙ্কাবতীর মা দুই জনে মিলিয়া কলিকাতায় লোক পাঠাইলেন। খেতুর মা রামহরিকে একখানি পত্র লিখিলেন।

 খেতুর মা লিখিলেন যে,— “কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হয়, এই আমার মনের বাসনা। এক্ষণে তনু রায় ও তাঁহার স্ত্রী, সেইজন্য আমার নিকট আসিয়াছেন। অন্য কোনও স্থানে যদি খেতুর বিবাহের কথা স্থির না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা কঙ্কাবতীর সহিত স্থির করিয়া তনু রায়কে পত্র লিখিবে।”

 এই চিঠি পাইয়া রামহরি, তাঁহার স্ত্রী ও খেতু, সকলেই আনন্দিত হইলেন। খেতুর হাতে পত্রখানি দিয়া বলিলেন,— “তোমার মার আজ্ঞা, ইহার উপর আর কথা নাই।”

 খেতু বলিলেন,— “মার যেরূপ অনুমতি, সেইরূপ হইবে। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই নাই। তনু কাকা তো মেয়েগুলিকে বড় করিয়া বিবাহ দেন। আর দুই-তিন বৎসর তিনি অনায়াসেই রাখিতে পরিবেন। ততদিনে আমার সব পাসগুলিও হইয়া যাইবে। ততদিনে আমিও দু’পয়সা আনিতেও শিখিব। আপনি এই মর্ম্মে তনু কাকাকে পত্র লিখুন।”

 রামহরি তনু রায়কে সেইরূপ পত্র লিখিলেন। তনু রায় সেকথা স্বীকার করিলেন। বিলম্ব হইল বলিয়া তাহার কিছুমাত্র দুঃখ হইল না, বরং তিনি আহ্লাদিত হইলেন।

 তিনি মনে করিলেন,— “স্ত্রীর কান্নাকাটিতে আপাততঃ একথা স্বীকার করিলাম। দেখি না, খেতুর চেয়ে ভাল পাত্র পাই কি না? যদি পাই—। আচ্ছা, সেকথা তখন পরে বুঝা যাইবে।”

 খেতুর মা, নিরঞ্জনকে সকল কথা বলিয়াছিলেন, নিরঞ্জন মনে করিলেন,— “বৃদ্ধ হইয়া তনু রায়ের ধর্ম্মে মতি হইতেছে।”

 কঙ্কাবতী আজ কয়দিন বিরস-বদনে ছিলেন। সকলে আজি কঙ্কাবতীর হাসি-হাসি মুখ দেখিল। সেইদিন তিনি মেনীকে কোলে লইয়া বিরলে বসিয়া কত যে তাহাকে মনের কথা বলিলেন, তাহা আর কি বলিব! মেনী এখন আর শিশু নহে, বড় একটি বিড়াল। সুতরাং কঙ্কাবতী যে তাহাকে মনের কথা বলিলেন, তাহার আর আশ্চর্য্য কি?

কঙ্কাবতী
২৯