পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পথে খেতু ষাঁড়েশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “শুনিতে পাই, আপনি প্রতিদিন হরি-সঙ্কীর্ত্তন করেন। তবে পাদ্‌রি সাহেবের নিকট আমাকে ওরূপ উপহাস করিলেন কেন?”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “উপহাস আর তোমাকে কি করিলাম? সে যাহা হউক, সন্ধ্যা হইয়াছে, আমার হরি-সঙ্কীর্ত্তনের সময় হইল। এস না, একটু দেখিবে? দেখিলেও পুণ্য আছে।”

 ষাঁড়েশ্বরের বাসা নিকট ছিল। খেতু ও ষাড়েশ্বর দুই জনে সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খেতু দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের দালানে হরি-সঙ্কীর্ত্তন আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু ষাঁড়েশ্বর সেখানে না যাইয়া বরাবর উপরের বৈঠকখানায় যাইলেন। খেতুকে সেইখানে বসিতে বলিয়া ষাঁড়েশ্বর বাটীর ভিতর গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ষাঁড়েশ্বর ফিরিয়া আসিলেন ও খেতুকে বলিলেন,— “খেতু! চল, অন্য ঘরে যাই।”

 খেতু অন্য ঘরে গিয়া দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের আর দুইটি বন্ধু সেখানে বসিয়া আছেন। সেখানে খানা খাইবার সব আয়োজন হইতেছে।

 নীচে হরি-সঙ্কীর্ত্তন চলিতেছে। ষাঁড়েশ্বর হিন্দুধর্ম্মের ও হিন্দুসমাজের একজন চাঁই।

 অল্পক্ষণ পরে খানা খাওয়া আরম্ভ হইল। দুই জন মুসলমান পরিবেশন করিতে লাগিল। খেতু বলিলেন,— “আপনারা তবে আহারাদি করুন, আমি এখন যাই।”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “না না, একটু থাক না, দেখ না, দেখিলেও পুণ্য আছে। এখন যা আমরা খাইতেছি, ইহা মাংসের ঝোল, ইহার নাম সুপ; একটু সূপ খাইবে?”

 খেতু বললেন,— “এসব দ্রব্য আমি কখনও খাই নাই, আমার প্রবৃত্তি হয় না। আপনারা আহার করুন?”

 আবার কিছুক্ষণ পরে ষাঁড়েশ্বর বললেন,— “খেতু! এখন যা খাইতেছি, ইহা ভেটকি মাছ। মাছ খাইতে দোষ কি? একটু খাও না?”

 খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! আমাকে অনুরোধ করিবেন না। আপনারা আহার করুন। আমি বসিয়া থাকি।”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “তবে না হয়, এই একটু খাও। ইহা অতি উত্তম ব্রাণ্ডি। পাদুরি সাহেবের কথায় মনে তোমার ক্লেশ হইয়া থাকিবে, একটু খাইলেই এখনি সব ভাল হইয়া যাইবে।”

 খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! যোড়হাত করিয়া বলি, আমাকে অনুরোধ করিবেন না। অনুমতি করুন, আমি বাড়ী যাই।”

 ষাঁড়েশ্বরের একটি বন্ধু বলিলেন,— “তবে না হয় একটু হ্যাম মুরগী খাও। এ হ্যাম— বিলাতি শূকরের মাংস। ইহা বিলাত হইতে আসিয়াছে। অভক্ষ্য, গ্রাম্য শূকর। বিলাতী শূকর খাইতে কোনও দোষ নাই। আর এ মুরগীও মহা-কুক্কুট, রামপাখী-বিশেষ। হগসাহেবের বাজার হইতে কেনা, যে-সে মুরগী নয়।”

 ষাঁড়েশ্বরের অপর বন্ধু বলিলেন,— “এইবার ভি—র কটলেট আসিয়াছে। খেতুবাবু নিশ্চয় এইবার একটু খাইবেন।”

 খানসামা এবার কি দ্রব্য আনিয়াছিল, সেকথা আর শুনিয়া কাজ নাই। নীচে হরি-সঙ্কীর্ত্তনের ধুম। তাঁহাই শ্রবণ করিয়া সকলে প্রাণ পরিতুষ্ট করুন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে দুই বন্ধুতে চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন। তখন এক বন্ধু উঠিয়া গিয়া খেতুকে ধরিলেন, অপরজন খেতুর মুখে ব্র্যাণ্ডি ঢালিয়া দিতে চেষ্টা করিলেন। ষাঁড়েশ্বর বসিয়া বসিয়া হাসিতে লাগিলেন।

কঙ্কাবতী
৩১