পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 খেতুর শরীরে বিলক্ষণ বল ছিল। এক এক ধাক্কায় দুই জনকেই ভূতলশালী করিলেন। তাহার পর মেজটি উল্টাইয়া ফেলিলেন। কাচের বাসন, কাচের গেলাস, সম্মুখে যাহা কিছু পাইলেন, আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। এইরূপ দক্ষযজ্ঞ করিয়া সেখান হইতে খেতু প্রস্থান করিলেন।


ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

বিড়ম্বনা

দেখিতে দেখিতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর এক্ষণে কুড়ি বৎসর বয়স। যা কিছু পাশ ছিল, খেতু সব পাশগুলি দিলেন। বাহিরেরও দুই-একটি পাশ দিলেন। শীর্ঘ একটি উচ্চপদ পাইবেন, খেতু এরূপ আশা পাইলেন।

 রামহরি ও রামহরির স্ত্রী ভাবিলেন যে, এক্ষণে খেতুর বিবাহ দিতে হইবে। দিন স্থির করিবার নিমিত্ত তাহারা খেতুর মাকে পত্র লিখিলেন।

 পত্রের প্রত্যুত্তরে খেতুর মা অন্যান্য কথা বলিয়া অবশেষে লিখিলেন,— “তনু রায়কে বিবাহের কথা কিছু বলিতে পারি নাই। আজকাল সে বড়ই ব্যস্ত, তাহার দেখা পাওয়া ভার। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে। মহাসমারোহে শ্রাদ্ধ হইবে, এই কার্য্যে তনু রায় একজন কর্ত্তা হইয়াছেন। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীর ধন্য কপাল! পুত্র দৌহিত্র চারিদিকে জাজ্বল্যমান রাখিয়া, অশীতিপর স্বামীর কোলে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে ইহার চেয়ে স্ত্রীলোকের পুণ্যবল আর কি হইতে পারে? যখন তাঁহাকে ঘাটে লইয়া যায়, তখন আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। সকলে একমাথা সিন্দুর দিয়া দিয়াছে, আর ভাল একখানি কস্তাপেড়ে কাপড় পরাইয়া দিয়াছে। আহা! তখন কি শোভা হইয়াছিল! যাহা হউক, তনু রায়ের একটু অবসর হইলে, আমি তাহাকে বিবাহের কথা বলিব।”

 কিছুদিন পরে খেতুর মা, রামহরিকে আর একখানি পত্র লিখিলেন। তাহার মর্ম্ম এই—

 “বড় ভয়ানক কথা শুনিতেছি। তনু রায়ের কথার ঠিক নাই। তাহার দয়া-মায়া নাই, তাহার ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান নাই। শুনিতেছি, সে না কি জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে। কি ভয়ানক কথা! আর জনার্দ্দন চৌধুরীও পাগল হইয়াছে না কি? পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে বর্ত্তমান। বয়সের গাছপাথর নাই। চলিতে ঠক-ঠক করিয়া কাঁপে। ঘাটের মড়া! তার আবার এ কুবুদ্ধি কেন? বিষয় থাকিলে, টাকা থাকিলে, এরূপ করিতে হয় না কি? তিনি বড়মানুষ, জমীদার, না হয় রাজা! তা বলিয়া কি একেবারে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়? বৃদ্ধ মনে ভাবে না। যে, মৃত্যু সন্নিকট? যেরূপ তাহার অবস্থা, তাহাতে আর কয়দিন? লাঠি না ধরিয়া একটি পা চলিতে পারে না। কি ভয়ানক কথা! আর তনু রায় কি নিকষা! দুধের বাছা কঙ্কাবতীকে কি করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করিবে? কঙ্কাবতীর কপালে কি শেষে এই ছিল? সেই মধুমাখা মুখখানি মনে করিলে, বুক ফাটিয়া যায়। শুনিতে পাই, কঙ্কাবতীর মা না কি রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন। আমি ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু আসেন নাই। বলিয়া পাঠাইলেন যে, দিদির কাছে আর মুখ দেখাইব না, এ কালা মুখ লোকের কাছে আর বাহির করিব না। এই বিবাহের কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আহা! তাহার মা'র প্রাণ! কতই না তিনি কাতর হইয়া থাকিবেন?”

৩২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ