পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পড়িয়া গেল যে, কুসুমবাটী নিবাসী শিবচন্দ্রের পুত্র, ক্ষেত্র, “বরফ” খাইয়া কৃস্তান হইয়াছে।

 সেইদিন রাত্রিতে ষাঁড়েশ্বর চারি বোতল মহুয়ার মদ আনিলেন। তারীফ শেখের বাড়ী হইতে চুপি-চুপি মুরগী রাঁধাইয়া আনিলেন। পাঁচ ইয়ার জুটিয়া পরমসুখে পান-ভোজন হইল। একবার কেবল এই সুখে ব্যাঘাত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। খাইতে খাইতে ষাঁড়েশ্বরের মনে উদয় হইল যে, তারীফ শেখ হয়তো মুরগীর সহিত বরফ মিশ্রিত করিয়াছে। তাই তিনি হাত তুলিয়া লইলেন, আর বলিলেন, —“আমার খাওয়া হইল না। বরফ-মিশ্রিত মুরগী খাইয়া শেষে কি জাতিটি হারাইব?” সকলে অনেক বুঝাইলেন যে, মুরগী বরফ দিয়া রান্না হয় নাই। তবে তিনি পুনরায় আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। পান-ভোজনের পর নিরঞ্জনের বাটিতে সকলে গিয়া ঢিল ও গোহাড় ফেলিতে লাগিলেন। এইরূপ ক্রমাগত প্রতি রাত্রিতে নিরঞ্জনের বাটীতে ঢিল ও গোহাড় পড়িতে লাগিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, নিরঞ্জন ও তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে পৈতৃক বাস্তৃভূমি পরিত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে চলিয়া গেলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কাকা মহাশয়! আপনি চলুন। আমিও এ-গ্রাম হইতে শীঘ্র উঠিয়া যাইব।”

 খেতুর মার নিকট যে ঝি ছিল, সে ঝিটি ছাড়িয়া গেল। সে বলিল,— “মঠাকুরাণি! আমি আর তোমার কাছে কি করিয়া থাকি? পাঁচজনে তাহা হইলে আমার হাতে জল খাইবে না।”

 আরও নানা বিষয়ে খেতুর মা উৎপীড়িত হইলেন। খেতুর মা ঘাটে স্নান করিতে যাইলে, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা দূরে দূরে থাকেন; পাছে খেতুর মা তাঁহাদিগকে ছুইয়া ফেলেন।

 যে কমল ভট্টাচার্য্যের কথা গদাধর ঘোষ বলিয়াছিল, সেই কমলের বিধবা স্ত্রী মুখ ফুটিয়া খেতুর মাকে বলিলেন, —"বাছা! নিজে সাবধান হইতে জানিলে কেহ আর কিছু বলে না! বসিতে জানিলে উঠেত হয় না। তোমার ছেলে বরফ খাইয়াছে, তোমাদের এখন জাতিটি গিয়াছে। তা বলিয়া আমাদের সকলের জাতিটি মার কেন? আমাদের ধর্ম্ম-কর্ম্ম নাশ কর কেন? তা তোমার বাছা দেখিতেছি, এ ঘাটটি না হইলে আর চলে না। সেদিন মেটে কলসটি যেই কাঁকে করিয়া উঠিয়াছি, আর তোমার গায়ের জলের ছিটা আমার গায়ে লাগিল, তিন পয়সার কলসীটি আমাকে ফেলিয়া দিতে হইল। আমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইল। আমরা তোমার বাছা, কি করিয়াছি? যে তুমি আমাদের সঙ্গে এত লাগিয়াছ?”

 খেতুর মা কোন উত্তর দিলেন না। কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “মা! কাঁদিও না। এখানে আর আমরা অধিক দিন থাকিব না। এ-গ্রাম হইতে আমরা উঠিয়া যাইব।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “বাছা! অভাগীরা যাহা কিছু বলে, তাহাতে আর দুঃখ করি না। কিন্তু তোমার মুখপানে চাহিয়া রাত্রি-দিন আমার মনের ভিতর আগুন জ্বলিতেছে। তোমার আহার নাই, নিদ্রা নাই; একদণ্ড তুমি সুস্থির নও! শরীর তোমার শীর্ণ, মুখ তোমার মলিন। খেতু! আমার মুখপানে চাহিয়া একটু সুস্থির হও, বাছা!”

 খেতু বলিলেন,— “মা! আর সাত দিন! আজ মাসের হইল ১৭ তারিখ। ২৪শে তারিখে কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। সেইদিন আশাটি আমার সমূলে নির্মূল হইবে। সেইদিন আমরা জন্মের মত এ-দেশ হইতে চলিয়া যাইব।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “দাসেদের মেয়ের কাছে শুনিলাম যে, কঙ্কাবতীকে আর চেনা যায় না। সে রূপ নাই, সে রং নাই, সে হাসি নাই। আহা! তবুও বাছা মা'র দুঃখে কাতর! আপনার সকল দুঃখ ভুলিয়া, বাছা-আমার মা'র দুঃখে দুঃখী। কঙ্কাবতীর মা রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন, আর কঙ্কাবতী মাকে বুঝাইতেছেন।”

কঙ্কাবতী
৪১