পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দ্রব্য লাগাইতে হইবে। অনেক টাকা খরচ হইবে। টাকা দিতে পরিবেন তো?”

 কাঁকড়াচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন,— “আমাদের টাকার অভাব কি? যত নৌকা-জাহাজ ডুবি হয়, তাহাতে যে টাকা থাকে, সে সব কোথায় যায়? সে সকল আমাদের প্রাপ্য। এক্ষণে আপনার কত টাকা চাই, তা বলুন?”

 খলিফা উত্তর করিলেন,— “যদি দুই তোড়া টাকা দিতে পারেন, তাহা হইলে উত্তম রাজ-পোষাক প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।”

 কাঁকড়া তৎক্ষণাৎ কচ্ছপের পিঠ হইতে লইয়া দুই তোড়া মোহর খলীফার সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন। খলীফা—অনেক রাজার পোষাক, অনেক বাবুর পোষাক, অনেক বরের পোষাক প্রস্তুত করিয়াছিলেন। কিন্তু একেবারে দুই তোড়া মোহর-কেহ কখনও তাঁহাকে দেয় নাই।

 মোহর দেখিয়া কঙ্কাবতী ব্যাকুল হইয়া বলিলেন,— “ও গো! তোমরা এ টাকাগুলি আমাকে দাও। আমি বাড়ী লইয়া যাই। আমার বাবা বড় টাকা ভালবাসেন, এত টাকা পাইলে বাবা কত আহ্লাদ করিবেন। এই ময়লা কাপড় পরিয়াই আমি না হয় তোমাদের রাণী হইব, ভাল কাপড়ে আমার কাজ নাই। তোমাদের পায়ে পড়ি, এই টাকাগুলি আমাকে দাও, আমি বাবাকে গিয়া দিই।”

 কাঁকড়া কঙ্কাবতীকে বকিয়া উঠিলেন। কাঁকড়া বলিলেন,— “তুমি বড় অবাধ্য মেয়ে দেখিতেছি! একবার তোমাকে মানা করিয়াছি যে, তুমি ছেলেমানুষ, আমাদের কথায় কথা কহিও না। চুপ করিয়া দেখ, আমরা কি করি।”

 কি করিবেন? কঙ্কাবতী চুপ করিয়া রহিলেন। মোহর পাইয়া খলীফার আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তিনি বলিলেন, “টাকাগুলি ভিতর রাখিয়া আসি, আর ভাল ভাল কাপড় বাহির করিয়া আনি। এইক্ষণেই তোমাদের রাণীর রাজবন্ত্র করিয়া দিব।”

 বাটীর ভিতর খলীফা দুই তোড়া মোহর লইয়া যাইলেন। আহ্লাদে পুলকিত হইয়া দন্তপাতি বাহির করিয়া একগাল হাসির সহিত সেই মোহর স্ত্রীকে দেখাইতে লাগিলেন।

 স্ত্রী অবাক! কি আশ্চর্য্য! “আজ সকালবেলা আমরা কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম?” খলীফানী এইরূপ ভাবিতে অবশেষে প্রকাশ্যে খলীফানী বলিলেন,— “এবার কিন্তু আমাকে ডায়মনকাটা তাবীজ গড়াইয়া দিতে হইবে।”

 তাহার পর খলীফা কঙ্কাবতীকে বাটীর ভিতর লইয়া গেলেন। স্ত্রীকে বলিলেন,— “ইনি রাণী। এঁর নাম কঙ্কাবতী। এঁর জন্য রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিতে হইবে। অতি সাবধানে তুমি ইহার গায়ের মাপ লও!”

 খলীফানী কঙ্কাবতীর গায়ের মাপ লইলেন। অনেক লোক নিযুক্ত করিয়া অতি সত্বর খলীফা রাজবন্ত্র প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন। খলীফা-রমণী যত্নে সেই পোষাক কঙ্কাবতীকে পরাইয়া দিলেন। রাজ-পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া কঙ্কাবতীর রূপ ফাটিয়া পড়িতে লাগিল।

 খলীফা-রমণী বলিলেন,— “আহা! মরি কি রূপ!”

 খলীফা বলিলেন,— “মরি কি রূপ!”

 সকলেই বলিলেন,— “মরি কি রূপ!”

 রাজ-পরিচ্ছদ পরা হইলে কাঁকড়া ও কচ্ছপ, কঙ্কাবতীকে লইয়া পুনরায় গৃহাভিমুখে চলিলেন। অনেক স্থল অনেক জল অতিক্রম করিয়া তিন জনে পুনরায় নদীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। সেখানে উপস্থিত হইলে, কঙ্কাবতীর মনোহর রূপ, মনোহর পরিচ্ছদ দেখিয়া, সকলেই চমৎকৃত হইল। সকলেই 'ধন্য ধন্য’ করিতে লাগিল। সকলেই বলিল,— “আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা কঙ্কাবতী হেন রাণী পাইলাম।”

৫০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ