পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “না, মাসি, বাবাকে গালি দিও না। জান তো, মাসি? বাবা দুঃখী মানুষ! ঘরে অনেকগুলি খাইতে। আমাকে না বেচিলে, বাবা, সংসার প্রতিপালন কি করিয়া করিবেন?”

 এইরূপ কথাবার্ত্তার পর স্থির হইল যে, কঙ্কাবতী এখন কিছুদিন গোয়ালিনীর ঘরে থাকিবেন। কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মাসি! প্রতিদিন তুমি পাড়ায় যাও। গ্রামে যেদিন যে ঘটনা হয়, আমাকে আসিয়া বলিও।”

 গোয়ালিনীর ঘরে কঙ্কাবতী বাস করিতে লাগিলেন। গ্রামে যেদিন যেখানে যাহা হয়, গোয়ালিনী আসিয়া তাঁহাকে বলে।

 একদিন গোয়ালিনী আসিয়া বলিল,— “আহা! খেতুর মা'র বড় অসুখ! খেতুর মা এবার বাঁচেন কি না!”

 অতিকাতরভাবে, কাঁদ-কাঁদ হইয়া, কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি হইয়াছে, মাসি? তাঁর কি হইয়াছে?”

 গোয়ালিনী উত্তর করিল,— “শুনিলাম, তাহার জ্বর-বিকার হইয়াছে। খেতু বৈদ্য ডাকিতে গিয়াছিলেন, কিন্তু বৈদ্য আসেন নাই। বৈদ্য বলিয়াছেন,— 'তোমার বাটীতে চিকিৎসা করিতে গিয়া, শেষে জাতিটি হারাইব না কি?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মাসি! তিনি আমাকে বড় ভালবাসেন। আমার আপনার মা যেরূপ, তিনিও আমার সেইরূপ। তাঁর অসময়ে আমি কিছু করিতে পারিলাম না, সেজন্য বড় দুঃখ মনে রহিল।”

 এই বলিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন।

 তাহার পরদিন অতি প্রত্যুষে কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মাসি! আজ একটু সকাল সকাল তুমি পাড়ায় যাও। শীঘ্র ফিরিয়া আসিয়া আমাকে বল, তিনি কেমন আছেন।”

 গোয়ালিনী সকাল সকাল পাড়ায় যাইল, সকাল সকাল ফিরিয়া আসিয়া কঙ্কাবতীকে বলিল,— “আহা! বড় দুঃখের কথা; খেতুর মা নাই! খেতুর মা মারা গিয়াছেন। মাকে ঘাটে লইয়া যাইবার নিমিত্ত, খেতু দ্বার দ্বার ঘুরিতেছেন, কিন্তু কেহই আসিতেছে না। সকলেই বলিতেছে,— “তুমি বরখ খাইয়াছ, তোমার জাতি গিয়াছে; তোমার মাকে ঘাটে লইয়া যাইলে আমাদের জাতি যাইবে।” ষাঁড়েশ্বর চক্রবর্ত্তী, গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি, আর কঙ্কাবতী। তোমার বাপ এই তিনজনে সকলকে মানা করিয়া বেড়াইতেছেন, যেন কেহ না যায়।”

 এই সংবাদ শুনিয়া কঙ্কাবতী একেবারে শুইয়া পড়িলেন। অবিশ্রান্ত কাঁদিতে লাগিলেন। গোয়ালিনী তাঁহাকে কত বুঝাইল। গোয়ালিনী কত বলিল,— “কঙ্কাবতী! চুপ কর। কঙ্কাবতী! উঠ, খাও।” কঙ্কাবতী উঠিলেন না, সেদিন রাঁধিলেন না, খাইলেন না। মাটিতে পড়িয়া কেবল কঁদিতে লাগিলেন।

 সন্ধ্যাবেলা কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মাসি! তুমি আর একবার পাড়ায় যাও। দেখ গিয়া সেখানে কি হইতেছে। শীঘ্র আসিয়া আমাকে বল।”

 গোয়ালিনী পুনরায় পাড়ায় যাইল। একটু রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। এক-প্রহর রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। মাটিতে শুইয়া, পথপানে চাহিয়া, কঙ্কাবতী কেবল কাঁদিতে লাগিলেন।

 একপ্রহর রাত্রি পর গোয়ালিনী ফিরিয়া আসিল। গোয়ালিনী বলিল,— “কঙ্কাবতী! বড়ই দুঃখের কথা শুনিয়া আসিলাম। খেতুর মাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত কেহই আসেন নাই। খেতু করেন কি? সন্ধ্যা হইলে কাঠ আপনি মাথায় করিয়া

কঙ্কাবতী
৫৩