প্রথম ঘাটে রাখিয়া আসিলেন। আহা! একেবারে অতগুলি কাঠ লইয়া যাইতে পরিবেন কেন? তিনবার কাঠ লইয়া তাহাকে ঘাটে যাইতে হইয়াছে। এখন তিনি মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছেন। একেলা আপনি কোলে করিয়া মাকে লইয়া যাইতেছেন। মরিলে লোক ভারি হয়। তাতে শ্মশানঘাট তো আর কম দূর নয়! খানিক দূর লইয়া যান, তারপর আর পারেন না। মাকে মাটিতে শয়ন করান, একটু বিশ্রাম করিয়া পুনরায় লইয়া যান। এইরূপ করিয়া তিনি এখন মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছেন। অন্ধকার রাত্রি। একটু দূরে দূরে থাকিয়া আমি এইসব দেখিয়া আসিলাম।”
এই কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত কঙ্কাবতী বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন, তাহার পর ধীরে দৌঁড়িলেন।
গোয়ালিনী বলিল,— “কঙ্কাবতী, কোথায় যাও? কঙ্কাবতী, কোথায় যাও?”
আর কোথায় যাও! আজি কঙ্কাবতী রাণী ধিরাণী, মহারাণী নন—আজি কঙ্কাবতী পাগলিনী। মনোহর রাজবেশে আজ কঙ্কাবতী সুসজ্জিতা নন, আজ কঙ্কাবতী গোয়ালিনীর একখানি সামান্য মলিন বসনপরিবৃতা। কঙ্কাবতীর মুখ আজ উজ্জ্বল প্রভা সম্পন্ন—আজি কঙ্কাবতীর মুখ ঘনঘটায় আচ্ছাদিত।
বাটীর বাহির হইয়া, মলিন বেশে, আলুলায়িত কেশে, পাগলিনী সেই শ্মশানের দিকে ছুটিলেন।
“কঙ্কাবতী শুন, কঙ্কাবতী শুন!” এই কথা বলিতে বলিতে কিয়দূরে গোয়ালিনী তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইল। কিন্তু কঙ্কাবতী তাহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না, একবার ফিরিয়াও দেখিলেন না।
রাহুগ্রস্ত পূর্ণশশী অবিলম্বেই নিশার তমোরাশিতে মিশিয়া যাইল। গোয়ালিনী আর তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। কাঁদিতে কাদিতে গোয়ালিনী বাড়ী ফিরিয়া আসিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
শ্মশান
দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া, পাগলিনী এখন শ্মশানের দিকে দৌড়িলেন। কিছুদূর যাইয়া দেখিতে পাইলেন, পথে খেতু মাতাকে রাখিয়াছেন, মা'র মস্তকটি আপনার কোলে লইয়াছেন; মা'র কাছে বসিয়া মা'র মুখ দেখিতেছেন আর কাঁদিতেছেন। অবিরল ধারায় অশ্রুবারি তাঁহার নয়নদ্বয় হইতে বিগলিত হইতেছে।
কঙ্কাবতী নিঃশব্দে তাঁহার নিকটে গিয়া দাঁড়াইলেন। অন্ধকার রাত্রি, সেই জন্য খেতু তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না।
মা'র মুখপানে চাহিয়া খেতু বলিলেন,— “মা! তুমিও চলিলে? যখন কঙ্কাবতী গেল, তখন মনে করিয়াছিলাম, এ ছাঁর জীবন আর রাখিব না। কেবল, মা, তোমার মুখপানে চাহিয়া বঁচিয়াছিলাম। এখন মা, তুমিও গেলে? তবে আর আমার এ প্রাণে কাজ কি? কিসের জন্য, কার জন্য আর বঁচিয়া থাকিব? এ সংসারে থাকা কিছু নয়। এখানে বড় পাপ, বড় দুঃখ। বেশ করিয়াছ, কঙ্কাবতী, এখান হইতে গিয়াছে! বেশ করিলে, মা! যে, এ পাপ সংসার হইতে তুমিও