পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ধর্ম্মপথ কখনও পরিত্যাগ না করি। অজ্ঞান কপটাচারী জনসমাজের ভ্রুকুটি-ভঙ্গিমায় ভীরু নরাধমদিগের মত কম্পিত হইয়া, যেন কর্ত্তব্যে কখনও পরাঙ্মুখ না হই। হে মা! প্রাণ যায় যাউক! পুরুষ হইয়া যেন কখনও কাপুরুষ না হই।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মা! তুমি স্বর্গে চলিলে, তোমার এই অনাথিনী কঙ্কাবতীর প্রতি একবার কৃপাদৃষ্টি কর। জাগরণে, শয়নে, স্বপনে, মা যেন ধর্ম্মে আমার মতি হয়, যেন ধর্ম্ম আমার গতি হয়। অধিক আর, মা, তোমাকে কি বলিব! কঙ্কাবতীর মনের কথা তুমি সকল জান। কঙ্কাবতীর প্রাণরক্ষা হউক না হউক, কঙ্কাবতীর ধর্ম্মরক্ষা হইবে। যদি এ-দিকের সূর্য্য ও-দিকে উদয় হন, যদি মহাপ্রলয় উপস্থিত হয়, তবুও কঙ্কাবতী যদি সতী হয়, কঙ্কাবতীকে কেহ ধর্ম্মচ্যুত করিতে পরিবে না। মনে মনে চিরকাল এই প্রতিজ্ঞা রহিয়াছে, আজ আবার, মা, তোমার পা ছুইয়া মুখ ফুটিয়া সেই প্রতিজ্ঞা করিলাম। হে মা! তোমার কঙ্কাবতী এখন পাগলিনী, তোমার কঙ্কাবতীর অপরাধ ক্ষমা কর।”

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! কি করিয়া চিতায় আগুন দিই? জনমের মত কি করিয়া মাকে বিদায় করি! আর মাকে দেখিতে পাইব না। এস কঙ্কাবতী! ভাল করিয়া আর একবার মা'র মুখখানি দেখিয়া লই!”

 মুখের নিকট দাঁড়াইয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া খেতু মা'র চুলগুলি নাড়িতে লাগিলেন। কঙ্কাবতী পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “দেখ কঙ্কাবতী! কি স্থির শান্তিময়ী মুখশ্রী! মা যেন পরমসুখে নিদ্রা যাইতেছেন। তোমার কি মনে পড়ে, কঙ্কাবতী! যখন তুমি বিড়াল লইয়া খেলা করিতে? প্রথম ভাগ বর্ণপরিচয় যখন তুমি পড়িতে পারিতে না? আমি তোমাকে কত বকিতাম, আর মা আমার উপর রাগ করিতেন। মা আমাকে যেরূপ ভালবাসিতেন, সেইরূপ তোমাকেও ভালবাসিতেন। আহা! কঙ্কাবতী! কি মা আমরা হারাইলাম!”

 এই প্রকারে নানারূপ খেদ করিয়া অবশেষে চিতা প্রদক্ষিণ করিয়া, খেতু অগ্নিকার্য্য করিলেন। চিতা ধূ-ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

 কঙ্কাবতী ও খেতু নিকটে বসিয়া মাঝে মাঝে কাঁদেন, মাঝে মাঝে খেদ করেন, আর মাঝে মাঝে অন্যান্য কথাবার্ত্তা কন। কি করিয়া জল হইতে রক্ষা পাইয়াছেন, কঙ্কাবতী সেই সমুদয় কথা খেতুকে বলিলেন। খেতু মনে করিলেন, নানা দুঃখে কঙ্কাবতীর চিত্ত বিকৃত হইয়াছে। দুঃখের উপর দুঃখ, এ আবার এক নূতন দুঃখ তাঁহার মনে উপস্থিত হইল। মনের কথা খেতু কিন্তু কিছু প্রকাশ করিলেন না। মা'র সৎকার হইয়া যাইলে, দুই জনে নদীতে স্নান করিলেন।

 তাহার পর খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! চল, তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি।”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “পুনরায় আমি কি করিয়া বাড়ী যাই? বাবা আমাকে তিরস্কার করবেন, দাদা আমাকে গালি দিবেন! আমি জলের ভিতর গিয়া মাছেদের কাছে থাকি, না হয় গোয়ালিনী মাসীর ঘরে যাই।”

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! সে কাজ করিতে নাই। তোমাকে বাড়ী যাইতে হইবে। যতই কেন দুঃখ পাও না, ঘরে থাকিয়া সহ্য করিতে হইবে। মনোযোগ করিয়া আমার কথা শুন! আর এখন বালিকার মত কথা কহিলে চলিবে না। ভীষণ মহাসাগরবক্ষে উন্মত্ত তরঙ্গ-তাড়িত জীর্ণদেহ সামান্য দুইখানি তরণীর ন্যায়, আমরা দুই জনে এই সংসার কর্ত্তৃক তাড়িত হইতেছি। তাই কঙ্কাবতী! বুদ্ধি-বিবেচনার সহিত আমাদের কথা বলিতে হইবে, বুদ্ধি-বিবেচনার সহিত আমাদের কাজ করিতে হইবে। মাতার পদযুগল ধরিয়া আজ রাত্রিতে যেরূপ ধীর জ্ঞানগম্ভীর

৫৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ