পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাক্য তোমার মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়াছিল, এখন হইতে সেইরূপ কথা আমি তোমার মুখে শুনিতে চাই। ভাবী ঘটনার উপর মনুষ্যদিগের সম্পূর্ণ কর্ত্তৃত্ব না থাকুক, অনেক পরিমাণে আছে। তা না হইলে, ভাবী ফলের প্রতীক্ষায় কৃষক কেন ক্ষেত্রে কর্ম্ম-বীজ বপন করিবে? উদ্যম-উৎসাহের সহিত মনুষ্য এই সংসারক্ষেত্রে কর্ম্ম-বীজ কেন রোপণ করিবে? মনুষ্যের অজ্ঞানতাবশতঃ ভাবী ঘটনার উপর কর্ত্তৃত্বের ইতরবিশেষ হইয়া থাকে। এই ভাবী ফলপ্রতীক্ষাই মনুষ্যের আশা-ভরসা। সেই আশা-ভরসাকে সহায় করিয়া আজ আমি তোমার নিকট হইতে বিদায় হইতেছি। তুমি বাড়ী চল, তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি। বাটীর বাহিরে তুমি পা রাখিয়াছ বলিয়া, জনার্দ্দন চৌধুরী আর তোমাকে বিবাহ করিবেন না। সত্বর অন্য পাত্র সংঘটন হওয়াও সম্ভব নয়। তোমার পিতা ভ্রাতা যাহা কিছু তোমার লাঞ্ছনা করেন, একবৎসরকাল পর্যন্ত সহ্য করিয়া থাক। শুনিয়াছি, পশ্চিম অঞ্চলে অধিক বেতনে কর্ম্ম পাওয়া যায়। আমি এক্ষণে পশ্চিমে চলিলাম। কাশীতে মাতার শ্রাদ্ধাদি-ক্রিয়া সমাধা করিয়া, কর্ম্মের অনুসন্ধান করিব। একবৎসরের মধ্যে যাহা কিছু অর্থসঞ্চয় করিতে পারি, তাহা আনিয়া তোমার পিতাকে দিব। আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তখন তোমার পিতা আহ্লাদের সহিত আমার প্রার্থনা পরিপূর্ণ করিবেন। কেবল একবৎসর, কঙ্কাবতী! দেখিতে দেখিতে যাইবে। দুঃখে হউক, সুখে হউক, ঘরে থাকিয়া, কোনও রূপে এই একবৎসরকাল অতিবাহিত কর।”

 তখন কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তুমি আমাকে যেরূপ আজ্ঞা করিবে, আমি সেইরূপ করিব।”

 দুইজনে ধীরে ধীরে গ্রামাভিমুখে চলিলেন। রাত্রি সম্পূর্ণ প্রভাত হয় নাই, এমন সময় দুই জনে তনু রায়ের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তবে এখন আমি যাই! সাবধানে থাকিবে।”

 'যাই যাই' করিয়াও খেতু যাইতে পারেন না। যাইতে খেতুর পা সরে না। দুইজনের চক্ষুর জলে তনু রায়ের দ্বার ভিজিয়া গেল।  একবার সাহসে ভর করিয়া খেতু কিছুদূর যাইলেন, কিন্তু পুনরায় ফিরিয়া আসিলেন, আর বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! একটি কথা তোমাকে ভাল করিয়া বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। কথাটি এই যে, অতি সাবধানে থাকিও।”

 আবার কিছুক্ষণ ধরিয়া দুইজনে কথা কহিতে লাগিলেন। ক্রমে প্রভাত হইল, চারিদিকে লোকের সাড়াশব্দ হইতে লাগিল।

 তখন খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! এইবার আমি নিশ্চয় যাই। অতি সাবধানে থাকিবে। কাঁদিও কাটিও না। যদি বঁচিয়া থাকি, তো একবৎসর পরে নিশ্চয় আমি আসিব। তখন আমাদের সকল দুঃখ ঘুচিবে! তোমার মাকে সকল কথা বলিও, অন্য কাহাকেও কিছু বলিবার আবশ্যক নাই।”

 খেতু এইবার চলিয়া গেলেন। যতদূর দেখা যাইল, ততদূর কঙ্কাবতী সেই দিকপানে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর, চক্ষুর জলে তিনি পৃথিবী অন্ধকারময় দেখিতে লাগিলেন। জ্ঞানশূন্য হইয়া ভূতলে পতিত হইবার ভয়ে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে তিনি ঠেশ দিয়া দাঁড়াইলেন। খেতু ফিরিয়া দেখিলেন যে, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় কঙ্কাবতী দাঁড়াইয়া আছেন। তাহার পর আর দেখিতে পাইলেন না।

 খেতু ভাবিলেন,— “হা জগদীশ্বর! মনুষ্য-হৃদয় তুমি কি পাষাণ দিয়াই নির্ম্মাণ করিয়াছ! যে, ঐ প্রভাহীনা মলিনা কাঞ্চন-প্রতিমাকে ওখানে ছাড়িয়া, এখানে আমার হৃদয় এখনও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় নাই।”

কঙ্কাবতী
৫৭