পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বাঘ

খেতু চলিয়া যাইলে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে ঠেশ দিয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত দ্বার ঠেলিতে তাঁহার সাহসী হইল না। অবশেষে, সাহসে বুক বাঁধিয়া, আস্তে আস্তে তিনি দ্বার ঠেলিতে লাগিলেন।

 শয্যা হইতে উঠিয়া, বাটীর ভিতর বসিয়া, তনু রায় তামাক খাইতেছিলেন। কে দ্বার ঠেলিতেছে, দেখিবার নিমিত্ত তিনি দ্বার খুলিলেন। দেখিলেন, কঙ্কাবতী!

 কঙ্কাবতীকে দেখিয়া তিনি বলিলেন,— “এ কি? কঙ্কাবতী যে! তুমি মর নাই? তাই বলি, তোমার কি আর মৃত্যু আছে! এতদিন কোথায় ছিলে? আজ কোথা হইতে আসিলে? এতদিন যেখানে ছিলে, পুনরায় সেইখানে যাও। আমার ঘরে তোমার আর স্থান হইবে না।”

 কঙ্কাবতী বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন না। সেই মলিন আর্দ্র বস্ত্রপরিহিতা থাকিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিলেন। পিতার কথায় কোনও উত্তর করিলেন না।

 পিতার তজ্জন-গৰ্জ্জনের শব্দ পাইয়া, পুত্রও সত্ত্বর সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভাই বলিলেন,— “এই যে, পাপীয়সী কালামুখ নিয়ে ফের এখানে এসেছেন। যাবেন আর কোন চুলো! কিন্তু তা হবে না—এ বাড়ী হইতে তোমার অন্ন উঠিয়াছে। এখন আর মনে করিও না জনার্দ্দন চৌধুরী তোমাকে বিবাহ করিবে। বাবা! পাড়ার লোক জানিতে না জানিতে কুলাঙ্গারী পাপীয়সীকে দূর করিয়া দাও।”

 বচসা শুনিয়া কঙ্কাবতীর দুই ভাগিনী বাহিরে দেখিলেন, দুঃখিনী কঙ্কাবতী দীন-দরিদ্র মলিনবেশে দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছেন। স্বামী ও পুত্র তাঁহাকে বিধিমতে ভর্ৎসনা করিয়াি তাড়াইয়া দিতেছেন।

 কঙ্কাবতীর মা কাহাকেও কিছু বলিলেন না। স্বামী কি পুত্র কাহারও পানে একবার চাহিলেন না। কঙ্কাবতীর বক্ষঃস্থল একবার আপনার বক্ষঃস্থলে রাখিয়া গদগদ মৃদুভাষে বলিলেন,— “এস, আমার মা এস! দুঃখিনী মা'কে ভুলিয়া এতদিন কোথা ছিলে, মা?”

 মা’র বুকে মাথা রাখিয়া কঙ্কাবতীর প্রাণ জুড়াইল। অন্তরে অন্তরে যে খরতর অগ্নি তাঁহাকে দহন করিতেছিল, সে অগ্নি এখন অনেকটা নির্ব্বাণ হইল।

 তাহার পর, মা, কঙ্কাবতীর একটি হাত ধরিলেন। অপর হাত দিয়া আর একটি মেয়ের হাত ধরিলেন। স্বামী ও পুত্রকে তখন সম্বোধন করিয়া বলিলেন,— “তোমরা কঙ্কাবতীকে দূর করিয়া দিবে? কঙ্কাবতীকে ঘরে স্থান দিবে না? বটে! এ দুধের বাছা কি হেন দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে যে, মা-বাপের কাছে ইহার স্থান হইবে না? মান-সন্ত্রম, পুণ্য-ধর্ম্ম লইয়া তোমরা এখানে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাক। আমরা চারিজন হতভাগিনী এখান হইতে বিদায় হই। এস, মা, আমরা সকলে এখান হইতে যাই। দ্বারে দ্বারে আমরা মুষ্টিভিক্ষা করিয়া খাইব, তবু এই মুনি-ঋষিদের অন্ন আর খাইব না?”

 তিন কন্যা ও মাতা, সত্য সত্যই বাটী হইতে প্রস্থান করিবার উপক্রম করিলেন। তখন তনু রায়ের মনে ভয় হইল।

 তনু রায় বলিলেন,— “গৃহিণী কর কি! তুমিও যে পাগল হইলে দেখিতেছি! এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? এ মেয়ের কি আর বিবাহ হইবে? সেই জন্য বলি, ওর যেখানে দুই চক্ষু যায়, সেইখানে ও যাক, ওর কথায় আর আমাদের থাকিয়া কাজ নাই।”

৫৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ