পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যদি এই মুহুর্ত্তে বনের বাঘ আসিয়া কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায়, তো আমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিই। যদি এই মুহুর্ত্তে বাঘ আসিয়া বলে,— “রায় মহাশয়! দ্বার খুলিয়া দিন, তো আমি তৎক্ষণাৎ দ্বার খুলিয়া দিই।”

 এই কথা বলিতে না বলিতে, বাহিরে ভীষণ গৰ্জ্জনের শব্দ হইল। গর্জ্জন করিয়া কে বলিল,— “রায় মহাশয়! তবে কি দ্বার খুলিয়া দিবেন?”

 সেই শব্দ শুনিয়া তনু রায় ভয় পাইলেন! কিসে এরূপ গর্জ্জন করিতেছে, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। দেখিবার নিমিত্ত আস্তে আস্তে দ্বার খুলিলেন। দ্বার খুলিয়া দেখেন, না, সর্ব্বনাশ! এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র বাহিরে দণ্ডায়মান!

 ব্যাঘ্র বলিলেন,— “রায় মহাশয়! এইমাত্র আপনি সত্য করিলেন যে, ব্যাঘ্র আসিয়া যদি কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায়, তাহা হইলে ব্যাঘ্রের সহিত আপনি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন। তাই আমি আসিয়াছি, এক্ষণে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিন; না দিলে এই মুহূর্ত্তে আপনাকে খাইয়া ফেলিব।”

 তনু রায় অতি ভীত হইয়াছিলেন সত্য, ভয়ে একপ্রকার হতজ্ঞান হইয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তবুও আপনার ব্যবসায়টি বিস্মরণ হইতে পারেন নাই।

 তনু রায় বলিলেন,— “যখন কথা দিয়াছি, তখন অবশ্যই আপনার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। আমার কথার নড়চড় নাই। মুখ হইতে একবার কথা বাহির করিলে, সে কথা আর আমি কখনও অন্যথা করি না। তবে আমার নিয়ম তো জানেন? আমার কুল-ধর্ম্ম রক্ষা করিয়া যদি আপনি বিবাহ করিতে পারেন তো করুন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই।”

 ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কত হইলে আপনার কুল-ধর্ম্ম রক্ষা হয়?”


 তনু রায় বলিলেন,— “আমি সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণ। সন্ধ্যা-আহ্নিক না করিয়া জল খাই না। এরূপ ব্রাহ্মণের জামাতা হওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। আমার জামাতা হইতে যদি মহাশয়ের অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে আপনাকে আমার সম্মান রক্ষা করিতে হইবে। মহাশয়কে কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করিতে হইবে।”

 ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন,— “তা বিলক্ষণ জানি! এখন কত টাকা পাইলে মেয়ে বেচিবেন তা বলুন।”

 তনু রায় বলিলেন,— “এ গ্রামের জমীদার, মান্যবর শ্রীযুক্ত জনার্দ্দন চৌধুরী মহাশয়ের সহিত আমার কন্যার সম্বন্ধ হইয়াছিল; দৈব্য-ঘটনাবশতঃ কার্য সমাধা হয় নাই। চৌধুরী মহাশয় নগদ দুই সহস্র টাকা দিতে স্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি মনুষ্য, ব্রাহ্মণ, স্বজাতি। আপনি তাহার কিছুই নন; সুতরাং আপনাকে কিছু অধিক দিতে হইবে।”

 ব্যাঘ্র বলিলেন,— “বাটীর ভিতর চলুন। আপনাকে আমি এত টাকা দিব যে, আপনি কখনও চক্ষে দেখেন নাই, জীবনে-স্বপনে কখনও ভাবেন নাই।”

 এই কথা বলিয়া, তৰ্জ্জন-গৰ্জ্জন করিতে করিতে, ব্যাঘ্র বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। তনু রায়ের মনে তখন বড় ভয় হইল। তনু রায় ভাবিলেন, এইবার বুঝি সপরিবারে খাইয়া ফেলে। নিরুপায় হইয়া তিনিও ব্যাঘ্রের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাটীর ভিতর যাইলেন।

 বাহিরে ব্যাঘ্রের গর্জ্জন শুনিয়া, এতক্ষণ কঙ্কাবতী, কঙ্কাবতীর মাতা ও ভগিনীগণ ভয়ে মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন। তনু রায়ের পুত্র তখন ঘরে ছিলেন না, বেড়াইতে গিয়াছিলেন। গুণবিশিষ্ট পুত্র, তাই অনেক রাত্রি না হইলে তিনি বাটী ফিরিয়া আসেন না।

 যেখানে কঙ্কাবতী প্রভৃতি বসিয়াছিলেন, ব্যাঘ্র গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলেন। সেইখানে সকলের সম্মুখে তিনি একটি বৃহৎ টাকার তোড়া ফেলিয়া দিলেন।

৬০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ