পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ব্যাঘ্র বলিলেন,— “খুলিয়া দেখুন, ইহার ভিতর কি আছে!”

 তনু রায় তোড়াটি খুলিলেন; দেখিলেন, তাহার ভিতর কেবল মোহর! হাতে করিয়া, চশমা নাকে দিয়া, আলোর কাছে লইয়া, উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন যে, মোহর নয়, প্রকৃত স্বর্ণমুদ্রা! সকলেই আশ্চর্য্য হইলেন যে, এত টাকা বাঘ কোথা হইতে আনিল? তনু রায়ের মনে আনন্দ আর ধরে না।

 তনু রায় ভাবিলেন,— “এতদিন পরে এইবার আমি মনের মত জামাই পাইলাম।”

 প্রদীপের কাছে লইয়া তনু রায় মোহরগুলি গণিতে বসিলেন।

 এই অবসরে, ব্যাঘ্র ধীরে ধীরে কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতার নিকট গিয়া বলিলেন,— “কোনও ভয় নাই!”

 কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতা চমকিত হইলেন। কার সে কণ্ঠস্বর, তাহা তাহারা সেই মুহূর্ত্তেই বুঝিতে পারিলেন। সেই কণ্ঠস্বর শুনিয়া তাঁহাদের প্রাণে সাহসী হইল। কেবল সাহস কেন? তাহাদের মনে অনির্ব্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল। কঙ্কাবতীর মাতা মৃদুভাবে বলিলেন,— “হে ঠাকুর! যেন তাঁহাই হয়!”

 ব্যাঘ্র এই কথা বলিয়া, পুনরায় তনু রায়ের নিকটে গিয়া থাবা পাতিয়া বসিলেন। তোড়ার ভিতর হইতে তনু রায় তিন সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা গণিয়া পাইলেন।

 ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তবে এখন?”

 তনু রায় উত্তর করিলেন,— “এখন আর কি? যখন কথা দিয়াছি, তখন এই রাত্রিতেই আপনার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। সেজন্য কোনও চিন্তা করবেন না। আর মনে করবেন না যে, ব্যাঘ্র বলিয়া আপনার প্রতি আমার কিছুমাত্র অভক্তি হইয়াছে। না না! আমি সে প্রকৃতির লোক নই। কাহারে কিরূপে মান-সন্ত্রম করিতে হয়, তাহা আমি ভালরূপ বুঝি। জনার্দ্দন চৌধুরী দূরে থাকুক, যদি জনার্দ্দন চৌধুরীর বাবা আসিয়া আজ আমার পায়ে ধরে, তবুও আপনাকে ফেলিয়া তাহার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিই না।”

 তাহার পর তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন,— “তুমি আমার কথার উপর কথা কহিও না; তাহা হইলে অনর্থ ঘটিবে; আমি নিশ্চয় ইহাকে কন্যা সম্প্রদান করিব। ইহার মত সুপাত্র আর পৃথিবীতে পাইব না। এ বিষয়ে আমি কাহারও কথা শুনিব না। যদি তোমরা কান্নাকাটি কর, তাহা হইলে এই ব্যাঘ্র মহাশয়কে বলিয়া দিব, ইনি এখনি তোমাদিগকে খাইয়া ফেলিবেন।”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “তোমার যাহা ইচ্ছা, তাহাই কর। আমি কোনও কথায় থাকিব না।”

 যাঁহার টাকা আছে, তাঁহার কিসের ভাবনা? সেই দণ্ডেই তনু রায় পুত্রকে ডাকিতে পাঠাইলেন, সেই দণ্ডেই প্রতিবাসী প্রতিবাসিনীগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন; সেই দণ্ডেই নাপিত পুরোহিত আসিলেন; সেই দণ্ডেই বিবাহের সমস্ত আয়োজন হইল।

 সেই রাত্রিতেই ব্যাঘ্রের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহকার্য্য সমাধা হইল। প্রকাণ্ড বনের বাঘকে জামাই করিয়া কার না মনে আনন্দ হয়? আজ তনু রায়ের মনে তাই আনন্দ ধরে না।

 প্রতিবাসীদিগকে তিনি বলিলেন,— “আমার জামাইকে লইয়া তোমরা আমোদ-আহ্লাদ করিবে। আমার জামাই যেন মনে কোনও রূপ দুঃখ না করেন!”

 জামাইকে তনু রায় বলিলেন,— “বাবাজি! বাসরঘরে গান গাহিতে হইবে। গান শিখিয়া আসিয়াছ তো? এখানে কেবল হালুম হালুম করিলে চলিবে না। শালী-শালাজ তাহা হইলে কান মলিয়া দিবে। বাঘ বলিয়া তাহারা ছাড়িয়া কথা ক'বে না!”

কঙ্কাবতী
৬১