পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বরং ইংদ্রুজ পিঁদ্রুজ দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে, তবু দেশী দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে না। আবার দেখ, বেদের কথা বল, শাস্ত্রের কথা বল, বিলাতী সাহেবেরা যদি ভাল বলেন, তবেই বেদ-পুরাণ ভাল হয়। দেশী পণ্ডিতদের কথা কেহ গ্রাহ্যও করে না। এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া আমাদের কোম্পানীর নাম দিয়াছি 'স্কল, স্কেলিটন এণ্ড কোং!' স্কেলিটন ভায়া ঐখানে দাড়াইয়া আছেন। এস তো, স্কেলিটন ভায়া, একটু এদিকে এস তো!”

 হাড় ঝম-ঝম্ করিতে করিতে স্কেলিটন আমার নিকটে আসিলেন। সর্ব্বশরীরের অস্থিকে স্কেলিটন বলে, কিন্তু এক্ষণে আমার সম্মুখে যিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তিনি দেখিলাম মুণ্ডহীন স্কেলিটন।

 তখন স্কল আমাকে পুনরায় বলিলেন,— “কেমন ভূতের উপর এখন তোমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইয়াছে তো?”

 আমি উত্তর করিলাম,— “পূর্ব্ব হইতেই আমার বিশ্বাস আছে। কারণ ভূতের ষড়যন্ত্রেই আমি এতদিন ধরিয়া ক্লেশভোগ করিতেছি; কিন্তু সে অন্যপ্রকার ভূত। এখন হইতে আপনাদিগের মত ভূতকে মানিয়া লইলাম। প্রত্যক্ষ চক্ষের উপর দেখিয়া আর কি করিয়া না মানি? তার জন্য আর আপনারা কোনও চিন্তা করিবেন না; যান, এক্ষণে ঘরে যান। রাত্রি অধিক হইয়াছে। আপনাদিগের ঘরের লোক ভাবিবে। আর, আমাকে একটু নিদ্রা যাইতে হইবে। কারণ, কাল প্রাতঃকালে আবার আমাকে পথ চলিতে হইবে!”

 স্কল তখন স্কেলিটনকে বলিলেন,— “দেখিলে, স্কেলিটন ভায়া! কোম্পানী খুলিলে কত উপকার হয়! ইংরেজি পড়িয়া এই বাবুটির মতিগতি একেবারেই বিকৃত হইয়া গিয়াছিল। দু’কথাতেই পুনরায় ইহাকে স্বধর্ম্মে আনয়ন করিলাম। এক্ষণে চল, অন্যান্য বিকৃতমতি বাবুদিগকে অন্বেষণ করি। ভূতবর্গের প্রতি যাহাতে তাঁহাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি হয়, চল, সেইরূপ উপায় করি।”

 স্কেলিটন হাড় ঝম্‌-ঝম্ করিলেন। আমি একটু কান পাতিয়া শুনিলাম যে, সে কেবল হাড় ঝম্‌-ঝম্ নয়। তাঁহার মুণ্ড নাই, সুতরাং মুখ দিয়া কথা কহিবার তাঁহার উপায় নাই। সেজন্য গায়ের হাড় নাড়িয়া, হাড় ঝম্‌-ঝম্ করিয়া তিনি কথাবার্ত্তা কহিয়া থাকেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সে কথা আমি অনায়াসে বুঝিতে পারিলাম।

 স্কেলিটন বলিলেন,— “যদি ইনি ভুতভক্ত হইলেন, তবে ইহাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। লোককে ভক্ত করিতে হইলে অর্থদান একটি তাহার প্রধান উপায়। অর্থ পাইলে লোকে অতি ধর্ম্মবান, অতি ভক্তিমান মহাপুরুষ হয়। অতএব তুমি ইহাকে ধনদান কর। যখন দেশে গিয়া, ইনি গল্প করিবেন, তখন শত শত লোক অর্থলোভে ভুতভক্ত হইবে।”

 আমি বলিলাম,— “সম্প্রতি আমার অর্থের নিতান্ত প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু আমি অর্থলোভী নই। ধন দিয়া আমাকে ভূতভক্ত করিতে হইবে না। আপনাদের অর্থ আমি লাইব না।”

 এই কথা শুনিয়া স্কল আরও প্রসন্নমূর্ত্তি ধারণ করিলেন। তিনি বলিলেন,— “এস, আমাদের সঙ্গে এস। আমাদের সঞ্চিত ধন তোমাকে দিলে, ধনের সফলতা হইবে, ধন সুপাত্রে অর্পিত হইবে, সে ধন দ্বারা মঙ্গল সাধিত হইবে, সেইজন্য তোমাকে আমাদের সঞ্চিত ধন দিব। জীবিত থাকিতে আমরা ধনের সদ্ব্যবহার করি নাই। এক্ষণে তোমা কর্তৃক সে ধনের সদ্ব্যবহার হইলে, আমাদের উপকার হইবে।”

 স্কেলিটনও আমাকে সেইরূপ অনেক অনুরোধ করিলেন। দুই ভূতের অনুরোধে আমি

৮০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ