পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাঁহাদিগের সঙ্গে চলিলাম। স্কেলিটন হাঁটিয়া চলিলেন, আর স্কল স্থানবিশেষে লাফাইয়া বা গড়াইয়া যাইতে লাগিলেন। প্রথমে তাঁহারা আমাকে অনেকগুলি ফল-বৃক্ষের নিকট লইয়া যাইলেন। আম্র, কদলী, পনস, কেন্দু, পিয়াল, প্রভৃতি নানা ফল সেইখানে সুপক্ক হইয়াছিল। সেই ফল আমাকে তাঁহারা আহার করিতে বলিলেন। আমি আহার করিলাম। তাহার পর তাঁহারা আমাকে সুশীতল স্ফটিকসদৃশ নির্বর দেখাইয়া দিলেন। জলপান করিয়া পিপাসা দূর করিলাম। সেখান হইতে আমরা পুনরায় চলিলাম। অল্পক্ষণ পরে এই পর্ব্বতের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। পর্ব্বতের একস্থানে আসিয়া স্কল বলিলেন,— “এইখানকার বন আমাদিগকে একটু পরিষ্কার করিতে হইবে। আজ সহস্ৰ বৎসর ধরিয়া এখানে জনমানব পদার্পণ করে নাই।” আমরা তিনজনে অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই বন পরিষ্কার করিতে লাগিলাম। পরিষ্কৃত হইলে পর্ব্বতের গাঁথুনির ঈষৎ একটু রেখা বাহির হইয়া পড়িল। স্কল, স্কেলিটন ও আমি অতিকষ্টে সেই গাথুনি পাথরগুলি ক্রমে খুলিয়া ফেলিলাম। গাঁথুনি খুলিতেই আমাদের এই অট্টালিকার সুড়ঙ্গপথটি বাহির হইয়া পড়িল। সুড়ঙ্গদ্বারে ভয়ঙ্করী নাকেশ্বরীকে দেখিলাম। নাকেশ্বরী খল-খল করিয়া হাসিল। কিন্তু যেই স্কল চক্ষু-কোটর বিস্তৃত করিয়া তাহার দিকে কোপ-কটাক্ষ করিলেন, আর সে চুপ করিল। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া আমরা এই অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিলাম। এই বিপুল ধনরাশি দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইলাম।

 স্কল বলিলেন,— “সহস্ৰ বৎসর পূর্ব্বে এই অঞ্চলের আমরা রাজা ছিলাম। প্রতিবেশী রাজগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া এই অপরিমিত ধন অর্জ্জন করি। জীবিত থাকিতে ধর্ম্মকর্ম্ম কিছুই করি নাই, কেবল যুদ্ধ ও ধনসঞ্চয় করিয়া জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলাম। আমাদের সন্তান-সন্ততি ছিল না। সে জন্য কিন্তু আমরা দুঃখিত ছিলাম না, বরং আনন্দিত ছিলাম। যেহেতু সন্তান-সন্ততি দ্বারা ধনের ব্যয় হইবার সম্ভাবনা। টাকা গনিয়া, টাকা নাড়িয়া-চাড়িয়া, আমরা স্বৰ্গ-সুখ উপভোগ করিতাম! আমাদের অবর্ত্তমানে পাছে কেহ এই ধন লয়, সেজন্য আমরা ইহার উপর 'যক' দিলাম, অর্থাৎ ইহার উপর এক ভূতিনীকে প্রহরীস্বরূপ নিযুক্ত করিলাম, এ-কার্য্যে যক্ষ বা যক্ষিণী নিযুক্ত করি নাই। কথায় লোকে বলে বটে, কিন্তু ধনের উপরে রক্ষা বা যক্ষিণী কেহ নিযুক্ত করিতে পারে না। যাহা হউক, আমাদিগের ধন-ঐশ্বর্যের উপর যক দিবার উদ্দেশ্যে প্রথমে পর্ব্বত-অভ্যন্তরে এই সুরম্য অট্টালিকাটি নির্ম্মাণ করিলাম। রাজবাড়ী হইতে সমুদয় টাকাকড়ি, মণি-মুক্তা, বসন-ভুষণ ইহার ভিতর লইয়া আসিলাম। যথাবিধি যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়া করিয়া নবমবর্ষীয়া সুলক্ষণা একটি বালিকাকে উৎসর্গ করিয়া, তাহাকে বলিয়া দিলাম যে, একসহস্ৰ বৎসর পর্য্যন্ত তুমি এই ধনের প্রহরিণীস্বরূপ নিযুক্ত থাকিবে। এক-সহস্ৰ বৎসরের মধ্যে যদি কেহ এই ধনের এক কণা মাত্রও লয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তুমি তাহার প্রাণ বধ করিবে। এক সহস্ৰ বৎসর পরে তুমি যেখানে ইচ্ছা সেইখানে যাইও, তখন যাহার অদৃষ্ট থাকিবে, সে এই ধনের অধিকারী হইবে। বালিকাকে এইরূপ আদেশ করিয়া, অট্টালিকার ভিতর একটি প্রদীপ জ্বালিয়া, আমরা সুড়ঙ্গের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। প্রদীপটি যেই নির্ব্বাণ হইল, আর বালিকার মৃত্যু হইল, মরিয়া সে ভীষণাকৃতি অতি দীর্ঘনাসিকা-ধারিণী ভূতিনী হইল। ভূতসমাজে সেজন্য সে নাকেশ্বরী নামে পরিচিত। দ্বারে যে এই প্রহরিণীস্বরূপ রহিয়াছে, সে সেই বিকৃত-আকৃতি ভূতিনী, যাহার বিকট হাসি তুমি এইমাত্র শুনিলে। বালিকা না রাখিয়া ধনের উপর অনেকে বালক-প্রহরী নিযুক্ত করিয়া থাকে। বালক মরিয়া ভূত হয়। কিছুদিন পরে যুদ্ধে আমরা হত হই। শক্রর তরবারি

কঙ্কাবতী
৮১