পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রবল বেগে কঙ্কাবতী একেবারে দ্বারের নিকট গিয়া পড়িলেন।

 কঙ্কাবতী পুনরায় উঠিলেন, পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে ধরিতে দৌড়িলেন। নাকেশ্বরী আর একটি নিশ্বাস ত্যাগ করিল, আর কঙ্কাবতী একেবারে অট্টালিকার বাহিরে গিয়া পড়িলেন।

 তখন কঙ্কাবতী আস্তে-ব্যস্তে পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে বলিলেন,— “ওগো! তোমাকে আমি আর ধরিতে যাইব না, তোমাকে আমি মারিব না। আমি আমার স্বামীকে আর ফিরিয়া চাই না। এখন কেবল এই চাই যে, স্বামী হইতে তুমি আমাকে পৃথক করিও না। স্বামীর পদযুগল ধরিয়া আমাকে মরিতে দাও। যদি মারিবে তো আমাদের দুইজনকেই একসঙ্গে খাও। আর তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তোমার নিকট এখন কেবল এই প্রার্থনাটি করি। ইহা হইতে তুমি আমাকে বঞ্চিত করিও না।”

 এই বলিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় ঘরের দিকে দৌড়িলেন। কোনও কথা না বলিয়া নাকেশ্বরী আর একটি নিশ্বাস ছাড়িল, আর কঙ্কাবতী একেবারে পর্ব্বতের বাহিরে বনের মাঝখানে গিয়া পড়িলেন।


দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ব্যাঙ-সাহেব

বনের মাঝে কঙ্কাবতী একেবারে নির্জ্জীব হইয়া পড়িলেন। বারবার উঠিয়া-পড়িয়া শরীর তাঁহার ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। শরীরের নানা স্থান হইতে শোণিতধারা বহিতেছিল। কঙ্কাবতীর এখন আর উঠিবার শক্তি নাই। উঠিয়াইবা কি করিবেন? স্বামীর নিকট যাইতে গেলেই নাকেশ্বরী আবার তাঁহাকে নিশ্বাসের দ্বারা দূরীকৃত করবে। বনের মাঝে পড়িয়া কঙ্কাবতী অবিরাম কাঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর পদপ্রান্তে পড়িয়া তিনি যে প্রাণ পরিত্যাগ করিতে পাইলেন না, এখন কেবল এই দুঃখ তাঁহার মনে অত্যন্ত প্রবল হইল। কাঁদিয়া কাদিয়া শরীর তাঁহার অবসান হইয়া পড়িল। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন,— আচ্ছা! তাই ভাল। স্বামী ভিতরে থাকুন, আমি এই বাহিরে পড়িয়া থাকি। তাঁহার পদযুগল ধ্যান করিতে করিতে এই বাহিরেই আমি প্রাণ পরিত্যাগ করিব। করুণাময় জগদীশ্বর আমার প্রতি কৃপা করিবেন। মরিয়া আমি তাঁহাকে পাইব।”

 এইরূপ চিন্তা করিয়া, কঙ্কাবতী স্বামীর পা দুটি মনে মনে প্রত্যক্ষ দেখিতে লাগিলেন,— উজ্জ্বল শুভ্রবর্ণ অল্প-আয়তন, চম্পককলিসদৃশ অঙ্গুলিবিশিষ্ট সেই পা দুখানি মনে মনে ধ্যান করিতে লাগিলেন। একাবিষ্টচিত্তে এইরূপ ধ্যান করিতেছেন, এমন সময় কঙ্কাবতীর মনে একটি নূতন ভাবের উদয় হইল। তিনি ভাবিলেন,— “ভূতিনী, প্রেতিনী, ডাকিনীতে মনুষ্যের মন্দ করিলে তাহার তো উপায় আছে! পৃথিবীতে অনেক গুণী মনুষ্য আছেন, তাহারা মন্ত্র জানেন, তাহারা তো ইহার চিকিৎসা করিতে পারেন। কেন বা আমার স্বামীকে তাহারা রক্ষা করিতে না পারিবেন? আর, যদি একান্তই আমার স্বামীর প্রাণরক্ষা না হয়, তাঁহার মৃতদেহ তো আমি পাইব। তাহা লইয়া পুড়িয়া মরিতে পারিলেও আমি কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিব। যাহা হউক, আমি আমার

কঙ্কাবতী
৮৭