পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জন্য লইব? দেবীর ভৈরবীপদের মধ্যে কি আছে যে এমন করিয়া আঁকড়াইয়া থাকিব? যে-কেহ নিক না, কি আমার আসিয়া যায়? ইহারা সবাই ত চোর-ডাকাত। যাহার যত শক্তি সে তত বড়ই দস্যু। সুবিধা ও সামর্থ্য মত অপরের গলা টিপিয়া কাড়িয়া লওয়াই ইহাদের কাজ। এই ত সংসার, এই ত সমাজ, এই ত মানুষের ব্যবসা! পীড়িত ও পীড়কের মাঝখানে ব্যবধান কতটুকু যে অহনির্শি এমন ভয়ে ভয়ে আছি! কিসের জন্য আমার এতবড় মাথাব্যথা! কিসের জন্য এতবড় বিরোধ সৃষ্টি করিয়াছি! এই ভৈরবীর আসন ত্যাগ করা কিসের জন্য এতবড় কঠিন! মুহূর্তের জন্য মনে হইল এ কাজ তাঁর পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়, কাল সকালেই সে এককড়ি ও জনার্দন রায়কে লিখিয়া পাঠাইয়া ভৈরবীর সকল দায়িত্ব স্বচ্ছন্দে ফিরাইয়া দিতে পারে, কোথাও কোন টান, কোন ব্যথা তাহার বাজিবে না।

 ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইল। পাশের কুলুঙ্গিতে তাহার কালি কলম ও কাগজ থাকিত; পড়িয়া লইয়া এই চিঠিখানা তখনই লিখিয়া ফেলিতে প্রস্তুত হইল। তাড়াতাড়ি কয়েক ছত্র লিখিয়া ফেলিয়া সহসা তার লেখনী রুদ্ধ হইল। সর্দার ও সাগরকে মনে পড়িল―পৃথিবীজোড়া কাড়াকাড়ি ও দস্যুপনার মাঝখানে কেবল এই দুটি দস্যুই আজও তাহাকে ত্যাগ করে নাই। সহসা নিজের কথা মনে পড়িয়া মনে হইল, তার পরে? দাঁড়াইবার কোথাও স্থান নাই―সবাই ত্যাগ করিয়াছে। কাল যাহারা তাহাকে ঘেরিয়া ছিল, আজ তারা শাসনের ভয়ে, জমিদারের গৃহপ্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া তাহারই বিরুদ্ধে পঞ্চায়েতি করিয়া আসিয়াছে। অথচ যে বেশীদিনের কথা নয়, ইহাদিগকে―কিন্তু থাক সে কথা। এই অত্যন্ত ছোটদের বিরুদ্ধে তাহার অভিযোগ নাই। এককড়ি, জনার্দন, শিরোমণি, তাহার পিতা তারাদাস, আর এই জমিদার―পুরানো ও নূতন অনেক কথা―কিন্তু সেও থাক; এ আলোচনাতে আজ আর কাজ নেই। তাহার ফকিরসায়েবকে মনে পড়িল। তিনি যে কি ভাবিয়া এমন করিয়া অকস্মাৎ চলিয়া গেলেন তাহার জানা নাই; কাহাকেও তিনি কোন হেতু, কাহারও বিরুদ্ধে কোন অনুযোগ করিয়া যান নাই। ইতিপূর্বেও তিনি এমনি নীরবে চলিয়া গেছেন; স্নেহ দিয়া, ভক্তি দিয়া, সসম্ভ্রমে বিদায় দিবার কোন অবসর কাহাকেও দেন নাই, হয়ত ইহাই তাঁহার প্রস্থানের পদ্ধতি। তবুও কেমন করিয়া যেন ষোড়শীর মনের মধ্যে ব্যথা একটা বিঁধিয়াই ছিল, তাঁর এই যাওয়াটাকে কোনক্রমে সে তাঁহার অভ্যাস বলিয়া সান্ত্বনা লাভ করিতে পারিতেছিল না। তিনি মাঝে মাঝে তাঁহার কথার প্রত্যুত্তরে বলিতেন, মা, আমি নিজের সঙ্গেই সম্বন্ধ ছেদ করিতে চাই, লোকের সঙ্গে নয়। তাই লোকালয়ের মায়া কাটাতে পারিনে―মানুষের মাঝখানে বাস করতেই ভালবাসি। তুমিও তোমার দেহটাকে যখন দেবতাকেই দিয়েছ, তখন সেই কথাটাই সকলের আগে মনে রেখো। কোন ছলে নিজের বলে যেন ভুল না হয়। দেবতার সঙ্গে আপনাকে জড়িয়ে আত্মবঞ্চনার চেয়ে বরঞ্চ দেবতাকে ছাড়াও ভাল। আজ এই বঞ্চনাই ত তাহাকে জালের মত জড়াইয়া ধরিয়াছে। আজ যদি তিনি থাকতেন। একবার যদি সে তাঁহার পায়ের কাছে গিয়া বসিতে পারিত! বহুপূর্বে একদিন তিনি

১০২