পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করে নাই, এবং যাহা কিছু কহিলেন সে যে তাঁহার নিজের কথা তাহাও সে মনে করিল না, কিন্তু জবাব দিবারও কিছু খাঁজিয়া পাইল না। এই আর্জি যিনি মুসাবিদা করিয়া আর একজনের মুখে গুঁজিয়া দিয়াছেন, তিনি সকল দিক চিন্তা করিয়াই দিয়াছেন এবং ইহাও তাঁহার অবিদিত নাই, যে নিছক পরোপকার মানসেই সে যে পশ্চিমের একপ্রাপ্ত হইতে স্ত্রীপুত্র ফেলিয়া চলিয়া আসিয়াছে, এ উত্তর সে কোনমতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিবে না।

 ঘণ্টা-দুই বিশ্রাম করার পর নির্মল যখন বাটীর বাহির হইল, তখন কর্তা সদরে বসিয়া ছিলেন! কিন্তু কোথায়, কি বৃত্তান্ত ইত্যাদি নিরর্থক প্রশ্নে সময় নষ্ট করিলেন না, শুধু একটু সকাল সকাল ফিরিবার অনুরোধ করিয়া বলিয়া দিলেন যে, এই শ্রান্ত দেহে অধিক বেলায় স্নানাহার করিলে অসুখ করিতে পারে।

 শিরোমণিমহাশয় পাশে বসিয়া কি বলিতেছিলেন, উঁকি মারিয়া দেখিয়া সবিস্ময়ে কহিলেন, বাবাজী―না?

 রায়মহাশয় বলিলেন, হাঁ।

 শিরোমণি ডাকিয়া আলাপ করিবার উদ্যম করিতেই জনার্দন বাধা দিয়া বলিলেন, নির্মল পালাচ্চে না, তোমার কথাটা শেষ কর, আমাকে উঠতে হবে।

 নির্মল নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিল। তাহার শ্বশুর যে তাহাকে অতি-কৌতূহলী প্রতিবেশীর অপ্রিয় জেরার দায় হইতে দয়া করিয়া অব্যাহতি দিলেন, ইহা অনুভব করিয়া তাহার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল।

 ষোড়শীর সহিত সে দেখা করিতে চলিয়াছিল! দিন-দুই পূর্বে যে উৎসাহ লইয়া, মনের ভিত্তিগাত্রে যে ছবি আঁকিয়া লইয়া সে তাহার প্রবাস-গৃহ ত্যাগ করিয়াছিল, সে আর ছিল না। যে স্বপ্ন সুদীর্ঘ যাত্রাপথের সকল দুঃখ তাহার হরণ করিয়াছিল, শ্বশুর ও শাশুড়ীর অব্যক্ত ও ব্যক্ত অভিযোগের আক্রমণে এইমাত্র তাহা লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছিল। সমবেত ও প্রবল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তাহার একক পৌরুষে নিরাশ্রয়ের অবলম্বন, দুর্বল, পরিত্যক্ত, নির্জিত নারীর নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে এই গ্রামে পদার্পণ করিতে চাহিয়াছিল। তাহার কত না বল, কত না শোভা, কিন্তু আসিয়া দেখিল তাহার নকল কার্যেরই ইতিমধ্যে একটা কারণ প্রকাশ হইয়া গেছে। তাহা যেমন কদর্য, তেমনি কালো। কালিতে লেপিয়া একাকার হইতে আর বাকী কিছু নাই। শ্বশুরকে কোনদিন আদর্শ পুরুষ মনে করে নাই; তিনি পল্লীগ্রামের বিষয়ী লোক, সামান্য অবস্থা হইতে যথেষ্ট সঞ্চয় করিয়াছেন, অতএব পরলোকের খরচের পাতাটিও সাদা পড়িয়া থাকিবার কথা নয়, ইহা সে বেশ জানিত এবং মনে মনে ক্ষমাও করিত; কিন্তু আজ যখন সে মন্দিরের প্রাচীর ঘুরিয়া পায়ে-হাঁটা সেই সরু পথ ধরিয়া ষোড়শীর কুটির অভিমুখে পা বাড়াইল, তখন সংক্ষুব্ধ চিত্ততরে তাহার একদিকে শ্বশুরের বিরুদ্ধে যেমন বিদ্বেষ ও ঘৃণা নিবিড় হইয়া দেখা দিল, তেমনি অন্যদিকে বিশেষ কিছু না জানিয়াও ষোড়শীর প্রতি অভিমান বিরক্তিতে মন তিক্ত হইয়া উঠিল। মনে মনে বার বার করিয়া

১১৮