পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।

 শুধু আমাকেই হবে?

 ষোড়শী ইহার কোন উত্তর না দিয়া ঘরের তালাটা হাতে লইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং জীবানন্দ বাহিরে আসিতেই কবাট বন্ধ করিয়া তাহার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া পুরোহিতের পিছনে পিছনে নিঃশব্দে প্রস্থান করিল। শুধু একাকী জীবানন্দ সেই অন্ধকার বারান্দায় ভূতের মত নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

তেইশ

 ব্যারিস্টার সাহেব চলিয়া গেছেন, ষোড়শী যাইতেছে―মন্দিরের চাবি-তালা সরঞ্জাম প্রভৃতি যাহা কিছু মূল্যবান সমস্ত আদায় হইয়া গেছে, ইত্যাদি সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে কিছুমাত্র বিলম্ব ঘটিল না। শিরোমণি আনন্দের আবেগে মুক্তকচ্ছ আলুথালু বেশে রায়মহাশয়ের সদরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 নির্মলের যাবার সময়ে বিদায়ের পালাটা বিশেষ প্রীতিকর হয় নাই। মনে মনে বোধ করি এই-সকল আলোচনাতেই জনার্দনের মখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিয়াছিল। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য করিবার অবস্থা শিরোমণির ছিল না, তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ডান হাত তুলিয়া গদগদ-কণ্ঠে কহিলেন, দীর্ঘজীবী হও ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে!

 জনার্দন মুখ তুলিয়া কহিলেন, ব্যাপার কি?

 শিরোমণি বলিলেন, ব্যাপার কি! দশখানা গাঁয়ে রাষ্ট্র হতে বাকী আছে নাকি? বেটী চাবিপত্র যা-কিছ, সমস্ত দিয়ে চলে যাচ্ছে যে। বলি, শোননি নাকি?

 যে ভদ্রলোক সকাল হইতে বসিয়া এ মাসে সুদের কিছু টাকা মাপ করিতে অনুনয় বিনয় করিতেছিল, সে কহিল, বেশ! যজ্ঞেশ্বর জানলেন না, আর খবর পেলেন ঘেঁটুমনসা? এ-সব করলে কে শিরোমণি খুড়ো, সমস্তই ত রায়মশাই।

 শিরোমণি আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, কিন্তু আসল চাবিটা শুনেচি নাকি গিয়ে পড়েচে জমিদারের হাতে? ব্যাটা পাঁড় মাতাল―দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।

 ক্রমশঃ একে একে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স্থির হইল, জমিদারের হাত হইতে চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই। বেলা তৃতীয় প্রহরে ঘুম ভাঙ্গিয়া হুজুর যখন মদ খাইতে আরম্ভ করিবেন, তাঁহার মাতাল হইয়া পড়িবার পূর্বেই সেটা হস্তগত করা প্রয়োজন। সেটা তাঁহার হাতে যাওয়ার সম্বন্ধে জনার্দন নিজের সামান্য একটু ত্রুটি ও অবিবেচনা স্বীকার করিয়া লইয়াই কহিলেন, সমস্ত স্থির

১৩৮