পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সংসারে আপনার বলতে আমার কেউ নেই, নিজের ছাড়া কারও সুখ-দুঃখের কখনও ভাগ পাইনি―সেও কি মা, আমার দোষ? আজ আছি, কাল যদি না থাকি, দুনিয়ার কারও ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই, একথা কি তুমিই কোনদিন ভেবেচ মা?

 এ অভিযোগ সে যে কাহার কাছে করিল, মা বলিয়া সে যে বিশেষ কাহাকে লক্ষ্য করিয়া ডাকিল, বোধ হয় সে নিজেই ঠিকমত উপলব্ধি করে নাই, তথাপি গিরিগাত্রস্খলিত উপলখণ্ড-সকল যেমন নির্ঝরের পথ ধরিয়া আপনার ভারবেগে আপনিই গড়াইয়া চলে, তেমন করিয়াই তাহার সদ্য উৎসারিত আকস্মিক বেদনার অনুভূতি চোখের জলের পথ ধরিয়া কথায় মালা গাঁথিয়া গাঁথিয়া নিরন্তর কহিয়া চলিতে লাগিল। মাঠের জলনিকাশের জন্য চাষীরা একবার এই পথের উপর দিয়া নালা কাটিয়া দিয়াছিল। নন্দী মহাশয়ের আদেশ অর্জন করিবার মত প্রচুর দক্ষিণা যখন তাহারা কোনমতেই সংগ্রহ করিতে পারে নাই, তখনই শুধু সর্বনাশ হইতে আত্মরক্ষা করিতে এই কাজ করিয়াছিল; কিন্তু দরিদ্রের এই দুঃসহ স্পর্ধা এককড়ি হুজুরের গোচর করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, নিরুপায়ের অশ্রুজলে ভ্রূক্ষেপমাত্র করেন নাই। স্থানটা তখন পর্যন্ত অসমতল অবস্থাতেই ছিল। দরিদ্রপীড়নের এই উৎকট চিহ্ন এই পথে কতবারই ত তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, কিন্তু আজ ইহাই চোখে পড়িয়া দুই চক্ষু অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিল। মনে মনে কহিল, আহা! কত ক্ষতিই না জানি হয়েছে। কত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে হয়ত পেট ভরে দু’বেলা খেতেও পাবে না। কেনই বা মানুষে এ-সব করে? জায়গাটা অন্ধকারেই ক্ষণকাল পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিল, হাতে টাকা থাকলে কালই মিস্ত্রি লাগিয়ে এটা বাঁধিয়ে দিতাম, প্রতি বৎসর এ নিয়ে আর তাদের দুঃখ পেতে হতো না। আচ্ছা, কত টাকা লাগে? সে পথ ছাড়িয়া মাঠে নামিয়া গেল এবং সমস্ত মন দিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল! এ-সম্বধে কোন ধারণাই তাহার ছিল না, কত ইঁট, কত চুন-বালি, কত কাঠ, কি কি আবশ্যক কিছুই সে জানিত না, কিন্তু কথাটা তাহাকে যেন পাইয়া বসিল। সেইখানে ভূতের মত অন্ধকারে একাকী দাঁড়াইয়া সে কেবলই মনে মনে হিসাব করিতে লাগিল, এই ব্যয় তাহার সাধ্যাতীত কি না।

 পথের ও-ধার দিয়া কি একটা ছুটিয়া গেল। হয়ত কুকুর কিংবা শিয়াল হইবে, কিন্তু তাহার চমক ভাঙ্গিল। পরের জন্য দুঃখ বোধ করা এমনই অভ্যাস বিরুদ্ধ যে চমক ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই ইহার সমস্ত তামাশাটা একমুহূর্তে ধরা পড়িয়া তাহার ভারী হাসি পাইল। তাড়াতাড়ি রাস্তায় উঠিয়া আসিয়া শুধু বলিল, বাঃ, বেশ ত কাণ্ড, কেউ যদি দেখে ত কি ভাববে! জীবানন্দ আজ মদ না খাইয়া বাহির হইয়াছিল, তাহার আজিকার এই মনের দুর্বলতার হেতু সে বুঝিল, অবসাদগ্রস্ত চিত্তের মাঝে কেন যে আজ অকারণে কেবল কান্নার সুরই বাজিয়া উঠিতেছে, ইহারও কারণ বুঝিতে তাহার বিলম্ব ঘটিল না। আরও একটা জিনিস, নিজের সম্বন্ধে আজ তাহার প্রথম সন্দেহ হইল যে দীর্ঘদিনের অভ্যাস আজ তাহার সর্বাঙ্গ ঘেরিয়া একেবারে স্বভাবে রূপান্তরিত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আপনাকে আপন বলিয়া দাবী করিবার দাবী হয়ত

১৪৬