পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ কথা স্বীকার করিতে চাহিল না। অন্তর হইতে সে বার বার কহিতে লাগিল এমন হইতেই পারে না! এমন হইতেই পারে না! বুভুক্ষুকে আহার দিবার আবার বিধিব্যবস্থা কি। ওই যে ক্ষুধার্ত অতিথি ওইখানে অনাহারে বসিয়া রহিল, ক্ষুধাকে তাহার বাঁধিয়া রাখিবে ইহারা কোন আইনকানুনে? কহিল, ওহে ভাই, কাল আবার আমি আসব, কিন্তু চুপিচুপি চলে যেতে পারবে না, তা বলে যাচ্ছি।

 কিন্তু ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলেন?

 জীবানন্দ কহিল, বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? ধীরে ধীরে বাহির হইয়া যাইতেছিল, হঠাৎ মন্দিরের বারান্দায় থামের আড়ালে মানুষের চাপা-গলা শুনিয়া বিস্মিত হইল। প্রথমে মনে করিল, নিভৃতে কেহ আরাধনা করিতে আসিয়াছে, কিন্তু কথাটা তার কানে গেল। কে একজন বলিতেছে, আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না বলে দিচ্চি।

 অন্যজন জবাব দিল, মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো―ফাঁসিতে যেতে হয়, তাও যাবো।

 আর একজন বলিল, হঃ―আমাদের আবার জেল! আমাদের আবার ফাঁসি! মা চলে যেতে চাচ্চে, আগে যাক―

 অন্ধকার না চিনিল মানুষ, না চিনিল গলা, তব মনে হইল একজনের গভীর কণ্ঠস্বর সে কোথাও যেন শুনিয়াছে, একেবারে অপরিচিত নয়। চেষ্টা করিলে হয়ত মনে করিতেও পারিত, কিন্তু আজ তাহার সেদিকে মনই গেল না। সে ত অনেকের অনেক সর্বনাশ করিয়াছে―অতএব নিজেই ত সে ইহার লক্ষ্য হইতে পারে, কিন্তু আজ তাহা নির্ণয় করিবার ইচ্ছাই হইল না। মনে মনে হাসিয়া কহিল, বাস্তবিক ঠাকুরদেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়! আহা!

 অলক্ষ্যে নিঃশব্দে যখন বাহির হইয়া আসিল তখন রাত্রি বোধ হয় দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। নির্মল কালো আকাশ তারায় তারায় ঠাসা। সেই অসংখ্য নক্ষত্র লোক হইতে ঝরিয়া অদৃশ্য আলোকের আভাস অন্ধকার পথের মাটিকে ধূসর করিয়া দিয়াছে। তাহারই মাঝে মাঝে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কঠিন মাটির স্তূপ পথশ্রান্ত পথিকের মত কতকাল ধরিয়া যেন নিঃশব্দে বসিয়া আছে। তাহার ইতিহাস নাই, তাহারই একটি পাশে গিয়া সে ঠিক তেমনি করিয়াই ধূলার উপর বসিয়া পড়িল।

 সুমুখে কতকটা পতিত জমির একধারে ষোড়শীর কুটীর, গাছের আড়ালে বেশ স্পষ্ট দেখা না গেলেও তাহার মনে হইল অনেকগুলি মানুষ যেন সার বাঁধিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং অনতিদূর দিয়া যখন চলিয়া গেল তখন ইহাদের কথাবার্তা হইতে জীবানন্দ এইটুকু সংগ্রহ করিল যে, ষোড়শীর যোগান আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এবং কাল প্রত্যুষেই সে চণ্ডীগড় তাগ করিয়া যাইবে। ভক্ত প্রজার দল তাহার পদধূলি লইরা ঘরে ফিরিতেছে। ষোড়শীকে নিষেধ করিবার পথ নাই, নিষেধ করিলে সে

১৫০