পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুনিবে না, এই কয়দিনে এতটুকু তাহাকে সে চিনিয়াছে―কিন্তু মন তাহার ব্যথায় ভরিয়া উঠিল। সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে ইহার বিরুদ্ধে যত অন্যায় করিয়াছে, একটি একটি করিয়া এতকাল পরে তাহার তালিকা করা অসম্ভব, কিন্তু সেই-সকল অগণিত অত্যাচারের সমষ্টি আজ তাহার চোখের উপর স্তূপাকার হইয়া উঠিল। ইহাকে সরাইরা রাখিবার স্থান সংসারে সে কোথাও দেখিল না। স্ত্রী বলিয়া স্বীকার করিতে যাহাকে লজ্জাবোধ করিয়াছে, গণিকা বলিয়া তাহাকেই কামনা করিবার শয়তানি সে যে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া পাইল না। আজ সমস্ত হৃদয় তাহার ষোড়শীকে একান্তমনে চাহিতেছে, এ তাহার অধিকারের দাবী, অথচ চিরদিন ইহাকেই উপেক্ষা করিয়া, অপমান করিয়া, মিথ্যার পরে মিথ্যা জমা করিয়া, সে যে প্রাচীর গড়িয়া তুলিয়াছে, আজ তাহাকে লঙ্ঘন করিবার পথ তাহার কৈ?

 হঠাৎ সম্মূখেই দেখিতে পাইল কে একজন দ্রুতপদে চলিয়াছে। তাহাকে অন্ধকারে চিনিতে বিলম্ব হইল না, ডাকিল, অলকা?

 ষোড়শী চমকিয়া দাঁড়াইল। এ যে জীবানন্দ তাহা সে ডাক শনিয়াই বুঝিয়াছিল। একটু সরিয়া আসিয়া তিক্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি এখানে কেন?

 জীবানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কি জানি, এমনিই বসে ছিলাম। তুমি যাবার আগে ঠাকুর প্রণাম করতে যাচ্চো, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।

 এই একটা বেলার মধ্যে তাহার কণ্ঠস্বরে কি যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়াছে, ষোড়শী বিস্ময়ে মৌন হইয়া রহিল। ক্ষণেক পরে কহিল, আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে, সে ত আপনি জানেন।

 জীবানন্দ বলিল, জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারে নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র―একগাছা লাঠিও সঙ্গে নেই।

ষোড়শী কহিল, শুনেচি। প্রফুল্লবাবু আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, তার কাছে খবর পেলাম আজ আপনি নিরস্ত্র বাড়ি থেকে একলা বেরিয়ে গেছেন, এবং―

 এবং ঝোঁকের উপর মদ না খেয়ে বার হয়ে গেছি, না?

 ষোড়শী কহিল, হাঁ। কিন্তু চণ্ডীগড়ে এ কাজ আর আপনি ভবিষ্যতে করবেন না।

 জীবানন্দ কহিল, এ কাজ আমি প্রত্যহ করব এবং যতদিন বাঁচব―করব। প্রফুল্ল তোমাকে এত কথা বলেচে, এ কথা বলেনি যে, এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি পৃথিবীতে আমার শত্রু, আছে এ আমি একদিনও আর স্বীকার করব না?

 ষোড়শী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইহার যুক্তি লইয়াও তর্ক করিল না, এ কথার স্থায়িত্ব লইয়াও প্রশ্ন করিল না। জীবানন্দের মুখের চেহারা অন্ধকারে সে দেখিতে পাইল না, কিন্তু এই তাহার অদ্ভুত কণ্ঠস্বর নিশীথে এই নির্জন প্রান্তরের মধ্যে তাহার দুই কান ভরিয়া এক আশ্চর্য সুরে বাজিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে কহিল, আমার সঙ্গে মন্দিরে গিয়ে আপনার কি হবে?

 জীবানন্দ কহিল, কিছুই না। শুধু যতক্ষণ আছি, সঙ্গে থাকব, তার পরে যখন

১৫১