পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জীবানন্দ একটুখানি ভাবিয়া বলিল, হয়ত জানি, হয়ত ভেবে দেখলে জানতেও পারব―কিন্তু সেই যে একদিন বলেছিলে সাবধানে থাকতে―কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। আজই কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কে দু’জন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ শপথ করে গেল, তাদের মায়ের যে সর্বনাশ করেছে তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না―আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সমস্ত শুনলাম―দু’দিন আগে হলে হয়ত মনে হতো, সে বুঝি আমি―দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হ’লো না―কি অলকা?

 না, কিছু নয়, বলিয়া ষোড়শী জোর করিয়া আবার সোজা হইয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে জীবানন্দ দেখিতে পাইল না, সহসা তাহার মুখ ছাইয়ের মত সাদা হইয়া গেল। কহিল, চলুন আমার ঘরে গিয়ে একটুখানি আজ বসতে হবে। আমাকে গাড়িতে তুলে না দিয়ে বাড়ি যেতে আপনাকে দেব না! আসুন―

পঁচিশ

 গরুর গাড়ির নীচে চাদর মুড়ি দিয়ে গাড়োয়ান শুইয়াছিল, সে ষোড়শীর পায়ের শব্দ অনুভবে বুঝিয়া কহিল, মা, শৈবাল-দীঘি ত দশ-বারো ক্রোশের পথ, একটু রাত থাকতে বার না হলে পৌঁছতে কাল প্রহর বেলা উতরে যাবে।

 ষোড়শী বলিল, আচ্ছা, তাই হবে। কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিল, কোথায় যাচ্ছি বোধ করি শুনতে পেলেন?

 জীবানন্দ কহিল, পেলাম বৈ কি?

 ষোড়শী কহিল, বেশী দূরে নয়। আপনার আক্রোশ এ পথটুকু অনায়াসে খুঁজে বার করতে পারবে!

 কিন্তু তোমার ওপর আক্রোশ ত আমার নেই।

 ঘর খুলিয়া ষোড়শী প্রবেশ করিল, কহিল, আমার একটিমাত্র কম্বল গাড়িতে পাতা। আপনাকে বসতে দিই এমন কিছু নেই। নির্মলবাবু হলে আঁচল বিছিয়ে দিতাম, কিন্তু আপনাকে ত তা মানাবে না। এই বলিয়া সে মুচকিয়া একটু হাসিয়া ঘরের কোণ হইতে একখানি কুশাসন গ্রহণ করিয়া মেঝের উপর পাতিয়া দিয়া বলিল, যদি অপরাধ না নেন ত―

 জীবানন্দ নিঃশব্দে উপবেশন করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

 এতবড় শ্লেষের উত্তর না পাইয়া ষোড়শী মনে মনে বিস্মিত হইল। প্রদীপের আলো অতিশয় ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল, ষোড়শী উজ্জ্বল করিয়া দিয়া সেটা হাতে করিয়া জীবানন্দের মুখের কাছে আনিয়া মুহূর্তকাল স্থিরভাবে থাকিয়া কহিল, কি ভাবচেন বলুন ত?

১৫৪