পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভাত খাইতে বসিয়া একসময় সে বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল। সম্মুখে খোলা দোরের দিকে পিঠ করিয়া ষোড়শী বসিয়াছিল, এই একটা সাধারণ প্রশ্নের ঠিকমত জবাব না পাইয়া সে বলিয়া উঠিল, আপনি কি ভাবচেন, আমার উত্তর দিচ্চেন না?

 জীবানন্দ মুখে তুলিয়া কহিল, কিসের?

 ষোড়শী বলিল, এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।

 জীবানন্দ বোধহয় অন্যমনস্কতার জন্যই বুঝিতে পারিল না, কহিল, কাজ নেই?

 ষোড়শী বলিল, কৈ, আমি ত আর দেখিতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পর আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে!

 কিন্তু তুমি ত অসতী নও। এই বলিয়া জীবানন্দ চোখ মেলিয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্ষণকালমাত্র তাহাদের চোখে চোখে মিলিল, তাহার পরে ষোড়শী মুখ ফিরাইয়া লইল। কিন্তু এতক্ষণ এত কথাবার্তার মধ্যে যে বস্তুটা লক্ষ্য করে নাই, এই ক্ষণিকের দৃষ্টিতে এই প্রথম দেখিতে পাইয়া সে যথার্থই বিস্মিত হইল। জীবানন্দের চোখে বুদ্ধির সেই অতি তীক্ষ্ণতা ছিল না, মুখের কথার মত চাহনি তাহার স্পষ্ট, সরল এবং স্থূল। তাহার বক্রোক্তি ও অভিমান যে এই লোকটির কাছে নিষ্ফল হইয়াছে তাহা সে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইল। একটু চুপ করিয়া কহিল, কিন্তু এ কথা ত এতদিন আমার চেয়ে আপনিই বেশী জানতেন।

 জীবানন্দ বলিল, কিন্তু নির্মল তোমাকে ভালবাসে এ ত সত্য।

 প্রত্যুত্তরে ষোড়শী তাহার আরক্ত মুখ অপরের দৃষ্টির আড়ালে রাখিয়া কহিল, সে কি আমার দোষ? আর কেউ যদি ভালবাসার কদর্যতায় জীবন আমার দুর্ভর করে তোলে, সেও কি আমার অপরাধ? কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সে তাহার মুখ দেখিয়া অনুতাপে বিদ্ধ হইয়া তাড়াতাড়ি কহিল, কিন্তু আমার দোষের জন্যে ত আর এরা দায়ী নয়। এই বলিয়া সে সম্মুখের অন্নপাত্রটা দেখাইয়া বলিল, খাওয়া বন্ধ হ’লো কেন? সবই যে পড়ে রইল।

 না, এই ত খাচ্চি, বলিয়া সে আহারে মন দিল।

 গাড়োয়ান হাঁকিয়া কহিল, মা আর কি বেশী দেরি হবে?

 না বাবা, আর বেশী দেরী হবে না। গলা খাটো করিয়া কহিল, চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে, তা বলে দিচ্চি?

 জীবানন্দ কহিল, কোথায় যাবো বল?

 কেন, আপনার নিজের বাড়িতে, বীজগাঁয়ে।

 বেশ, তাই যাবো।

 কিন্তু কালকেই যেতে হবে।

 জীবানন্দ মুখ তুলিয়া বলিল, কালই? কিন্তু কাজ আছে যে। মাঠের জলনিকাশের একটা সাঁকো করা দরকার। এদের জমিগুলো সব ফিরিয়ে দিতে হবে,

১৫৭