পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জীবানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, তোমার জন-দুই অন্তরঙ্গ পরম বন্ধু আছে শুনেছি। সত্যি?

 ষোড়শী তেমনি মাথা নাড়িয়া বলিল, মিছে কথা।

 জীবানন্দ আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তোমার পূর্বেকার সকল ভৈরবীই মদ খেতেন―সত্যি?

 ষোড়শী কহিল, সত্যি।

 জীবানন্দ কহিল, মাতঙ্গী ভৈরবীর চরিত্র ভাল ছিল না―এখনো তার সাক্ষী আছে। সত্যি না মিছে?

 ষোড়শী লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে কহিল, সত্যি বলেই শুনেছি।

 জীবানন্দ কহিল, শুনেছ? ভাল। তবে হঠাৎ তুমিই বা এমন দলছাড়া গোত্রছাড়া ভাল হতে গেলে কেন?

 প্রত্যুত্তরে ষোড়শী এই কথা বলিতে গেল যে ভাল হইবার অধিকার সকলেরই আছে; কিন্তু সহসা একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর তাহাকে মাঝখানেই থামাইয়া দিল। জমিদার জীবানন্দ সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, মেয়েমানুষের সঙ্গে তর্কও আমি করিনে, তাদের মতামতও কখনও জানতে চাইনে। তুমি ভাল কি মন্দ, চুল চিরে তার বিচার করবারও আমার সময় নেই। আমি বলি চণ্ডীগড়ের সাবেক ভৈরবীদের যেভাবে কেটেছে, তোমারও তেমনিভাবে কেটে গেলেই যথেষ্ট। আজ তুমি এই বাড়ীতেই থাকবে।

 হুকুম শুনিয়া ষোড়শী বজ্রাহতের ন্যায় একেবারে কাঠ হইয়া গেল। জীবানন্দ কহিতে লাগিল, তোমার সম্বন্ধে কি করে যে এতটা সহ্য করেচি জানিনে, আর কেউ এ বেয়াদপি করলে এতক্ষণে তাকে পাইকদের ঘরে পাঠিয়ে দিতুম। এমন অনেককে দিয়েচি।

 ইহা ভিত্তিহীন শূন্য আস্ফালন নহে, তাহা শুনিলেই বুঝা যায়। ষোড়শী অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিল, গলায় আঁচল দিয়া দুই হাত জোড় করিয়া কেবল কহিল, আমার যা-কিছু আছে সব নিয়ে আজ আমাকে ছেড়ে দিন।

 জীবানন্দ মুহূর্তকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কেন বল তো? এ-রকম কান্নাও নতুন নয়, এ-রকম ভিক্ষেও এই নতুন শুনচি নে। কিন্তু তাদের সব স্বামী-পুত্র ছিল―কতকটা না হয় বুঝতেও পারি।

 তাহাদের স্বামী-পুত্র ছিল। শুনিয়া যোড়শী শিহরিয়া উঠিল।

 জীবানন্দ কহিতে লাগিল, কিন্তু তোমার ত সে বালাই নেই! পনর-ষোল বছরের মধ্যে তোমার স্বামীকে ত তুমি চোখেও দেখনি। তাছাড়া তোমাদের ত এতে দোষ নেই।

 ষোড়শী যুক্তহস্তেই দাঁড়াইয়া ছিল, অশ্রুরুদ্ধস্বরে বলিল, স্বামীকে আমার ত মনে নেই সত্যি, কিন্তু তিনি ত আছেন। যথার্থ বলচি আপনাকে, কখনো কোন অন্যায়ই আমি আজ পর্যন্ত করিনি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।

১৬