পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তারাদাস কহিল, কাল রাত্রে ষোড়শী চলে গেছে―

 আমি খবর পেয়েচি।

 গোটাকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্চে না―

 তা হলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।

 এই অগ্নিদাহের সম্বন্ধে অচিরকালমধ্যে মুখে মুখে নানা কথা প্রচলিত হইয়া গেল। জমিদার সে রাত্রে গৃহে ছিলেন না, ইহা লইয়া অধিক আলোচনা অনেকের কাছেই নিষ্প্রয়োজন মনে হইল, কিন্তু ষোড়শী ভৈরবীর যাওয়ার সহিত যে ইহার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে এবং এ কাজ যাহারা করিয়াছে জানিয়া-বুঝিয়াও যে জমিদার তাহাকে অব্যাহতি দিলেন এই কথা লইয়া অনুমান ও সংশয়-প্রকাশের অবধি রহিল না। এককড়ির ফাঁদের মধ্যে জীবানন্দ পা দিল না দেখিয়া ইঁহার বিষয় বুদ্ধির প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িল, কিন্তু নিজের জন্য তিনি অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। ষোড়শীকে তাড়ানোর কাজে তিনিও একজন পাণ্ডা এবং জমিদারের গৃহ যাহারা ভস্মীভূত করিয়া দিল তাহারা আশেপাশেই কোথাও অবস্থিতি করিতেছে, এই কথা স্মরণ করিয়া বিছানার মধ্যে তাঁহার সর্ব শরীর ঘর্মাপ্লুত হইয়া উঠিল। পাহারার জনা চারিদিকে লোক মোতায়েন করিয়াও তিনি সারারাত্রি বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আর শুধু কি কেবল বাড়ি! তাঁহার অনেক ধানের গোলা অনেক খড়ের মাড়, শস্যসঞ্চয়ের বিপুল ব্যবস্থা―এই সকল রক্ষা করিতে তাঁহাকে অনুক্ষণ সতর্ক থাকিতে হইবে। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগিল―তবুও অতগুলো যা হোক করিয়া কাটিয়াছে, কিন্তু ইতিমধ্যে এমন একটা কাণ্ড ঘটিল যাহাতে ভাবিয়া পার হইবার আর পথ রহিল না। আদালতের পরওয়ানা আসিয়া পৌঁছিল, ভূমিজ ও অন্যানা প্রজারা একযোগে জমিদার ও তাহার নামে নালিশ রুজু করিয়াছে। যে জমিটা তাঁহারা একত্রে আকের চাষ ও গুড়ের কারখানা করিতে মাদ্রাজী সাহেবকে বিক্রি করিয়াছিলেন, তাহাই বাতিল ও নাকচ করিবার আবেদন। খবর আসিয়াছে কোর্টের প্রস্তাবে ও ইঙ্গিতে কলেক্টর সাহেব স্বয়ং সরজমিনে আসিয়া তদন্ত করিয়া যাইবেন। অনেক টাকার ব্যাপার, অতএব এককড়ির সহযোগে অনেক ঢেরা-সই করিয়াছেন, অনেক বন্ধকী তমসুক ও কর্জার খত প্রস্তুত করিয়াছেন―একের বিষয় অপরকে বিক্রয় করিবার যতপ্রকার গলিঘুঁজি আছে অতিক্রম করিয়াছেন―সেই সব মনশ্চক্ষে উপলব্ধি করিয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিন্তু ইহার চেয়েও একটা বড় কথা এই যে, এই-সকল হীন, মূর্খ, মৃতকল্প চাষীর দল এত বড় সাহস পাইল কি করিয়া যে, গ্রামের মধ্যে বাস করিয়াও এই দুর্দান্ত জীবানন্দ চৌধুরী ও জনার্দন রায়ের নামে নালিশ করিয়া বসিল! জীবনের অধিকাংশ কাল যাহারা পেট ভরিয়া খাইতে পায় না, শীতের রাত্রে যাহারা বসিয়া কাটায়, মারীর দিনে যাহারা কুকুর-বেড়ালের মত মরে, আবাদের দিনে একমুষ্টি বীজের জন্য যাহারা ওই দরজার বাহিরে পড়িয়া হত্যা দেয়, তাহারা আদালতে দাঁড়াইবার টাকা পাইল কাহার কাছে। এ দুর্মতি তাহাদের কে দিল? সে কি এই সোজা কথাটা ইহাদের বলিয়া দিতে পারিল না যে, কেবল জেলা আদালতেই নয়, হাইকোর্ট বলিয়াও একটা ব্যাপারও আছে, যেখানে জীবানন্দ-

১৬২