পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না। আজ সকালে এইটাই তাহার বেদখল করা হইয়াছে। জনার্দন ধীরে ধীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, অনেকেই হাজির আছেন। শিরোমণি, তারাদাস, গগন চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজন তাঁহার দলভুক্ত ভদ্রব্যক্তিদের সমক্ষে জীবানন্দ চৌধুরী নিজে হুকুম দিয়া এবং নিজের লোক দিয়া তাঁহার বেড়া ভাঙ্গাইয়া মন্দির-সংলগ্ন ভূখণ্ডের অন্তর্গত করিয়া দিয়াছেন। কেহই প্রতিবাদ করিতে ভরসা করে নাই।

 জনার্দন দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া সবিনয়ে কহিলেন, এ-সব করার আগে হুজুর ত আমাকে একটা খবর পাঠাতে পারতেন?

 জীবানন্দ হাসিয়া কহিলেন, তাতে অনর্থক দেরি হতো বৈ ত নয়, খবর আপনার কাছে পৌঁছবেই জানি।

 জনার্দন বলিলেন, খবর পৌঁছেচে, কিন্তু একটা দিন আগে পৌঁছলে মামলা-মকদ্দমাটা হয়ত বাধত না।

 জীবানন্দ তেমনি হাসিমুখে কহিলেন, এতেও ত বাধা উচিত নয় রায়মশাই। ভৈরবীদের হাতে দেবীর অনেক সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে, আবার সেগুলো হাতবদল হওয়া দরকার।

 জনার্দন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া কহিলেন, তার চেয়ে আর সুখের কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই, সমস্ত গ্রামখানিই নাকি একদিন মা চণ্ডীর ছিল, এখন কিন্তু―খোঁচাটা সকলেই উপভোগ করিলেন। শিরোমণি ঠাকুর ত জনার্দন রায়ের বুদ্ধি ও বাক-চাতুর্যে উল্লসিত হইয়া উঠিলেন।

 জীবানন্দের মুখের চেহারায় কোনরূপ পরিবর্তন লক্ষিত হইল না। বলিলেন, তার ত্রুটি হবে না রায়মশাই। মা চণ্ডীর সমস্ত দলিল-পত্র, নক্‌শা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু ছিল আমি কলকাতায় এ্যাটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েচি। কিন্তু আপনারা আমার সহায় থাকবেন।

 শিরোমণি জয়ধ্বনি করিলেন; কিন্তু কথাটা সত্য হইলে কোথাকার জল কোথায় গিয়া মরিবে চিন্তা করিয়া ক্রোধে ও শঙ্কায় জনার্দনের মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু ইহার চেয়েও ঢের বড় বিপদ তাঁহার মাথার পরে ঝুলিতেছে স্মরণ করিয়া আজিকার মত তিনি আত্মসংবরণ করিয়া গৃহে ফিরিলেন। যে উদ্দেশ্যে বাটীর বাহির হইয়াছিলেন তাহা ব্যর্থ হইল। পথে চলিতে চলিতে তাঁহার মনে হইল, আমার নাহয় দু-একশ’ বিঘা টান ধরিতে পারে, কিন্তু নিজে যে সমস্ত চণ্ডীগড় গিলিয়া বসিয়াছেন তাহার কি? সুতরাং কথাটা যে নেহাত বাজে, নিছক ধোঁকা দিবার জন্যই বলা এ বিষয়ে আর সন্দেহ রইল না। বাড়ি ঢুকিয়া তামাকের জন্য একটা হুঙ্কার ছাড়িয়া বসিবার ঘরে পা দিয়াই কিন্তু তিনি চমকিয়া গেলেন। একধারে লুকাইয়া বসিয়া এককড়ি। তাহার মুখ শুষ্ক, চেহারা ম্লান―কি হে, তুমি যে হঠাৎ এখানে? তোমার পাগল মনিব ত ওদিকে লাঠালাঠি বাধিয়েচেন।

 এককড়ি কহিল, জানি। আর সেই পাগলের কাছেই এখনি একবার আমাদের ছুটতে হবে।

 জনার্দন ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন বল ত?

১৬৫