পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শীর্ণ নাকটা যেন খাঁড়ার মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সমস্ত মুখখানা অত্যন্ত ম্লান, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া ভিতরের কি একটা অব্যক্ত বেদনা যেন কালিমব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে।

 জীবানন্দ হাত নাড়িয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, তোমার ভয় নেই, কাছে এসো।

 ষোড়শী ধীরে ধীরে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া নতনেত্রে নীরবে দাঁড়াইল। জীবানন্দ কহিল, পুলিশের লোক বাড়ি ঘিরে ফেলেছে―ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব গেটের মধ্যে ঢুকেছেন―এলেন বলে।

 ষোড়শী মনে মনে চমকিয়া উঠিল, কিন্তু কথা কহিল না। জীবানন্দ বলিতে লাগিল, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট টুরে বেরিয়ে ক্রোশখানেক দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন, তোমার বাবা কাল রাত্রেই তার কাছে গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন। কেবল তাতেই এতটা হতো না, কে-সাহেবের নিজেরই আমার উপর ভারী রাগ। গত বৎসর দুবার ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পারেনি―আজ একেবারে হাতে হাত ধরে ফেলেছে, বলিয়া সে একটু হাসিল।

 এককড়ি মুখ চুন করিয়া পাশে দাঁড়াইয়াছিল, কহিল, হুজুর, এবার বোধ হয় আমাদেরও আর রক্ষে নেই।

 জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সম্ভব বটে। ষোড়শীকে কহিল, শোধ নিতে চাও ত এই-ই সময়। আমাকে জেলে দিতেও পারো।

 ষোড়শী জবাব দিতে গিয়া মুখ তুলিয়াই দেখিল জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। চোখ নামাইয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, এতে জেল হবে কেন?

 জীবানন্দ কহিল, আইন। তা ছাড়া কে-সাহেবের হাতে পড়েচি। বাদুড়বাগানের মেসে থাকতে, এরই কাছে একবার দিন-কুড়ি হাজতবাসও হয়ে গেছে। কিছুতে জামিন দিলে না—আর জামিন বা তখন হতো কে?

 ষোড়শী হঠাৎ উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, আপনি কি কখনো বাদুড়বাগানের মেসে ছিলেন?

 জীবানন্দ কহিল, হাঁ। এই সময়ে একটা প্রণয়কাণ্ডের বৃন্দে হয়েছিলুম―ব্যাটা আয়ান ঘোষ কিছুতেই ছাড়লে না―পুলিশে দিলে। যাক সে অনেক কথা। সে আমাকে ভোলেনি, বেশ চেনে। আজও পালাতে পারতাম, কিন্তু ব্যথায় শয্যাগত হয়ে পড়েছি, নড়বার জো নেই।

 ষোড়শী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কালকের ব্যথাটা কি আপনার সারেনি?

 জীবানন্দ কহিল, না, ভয়ানক বেড়েছে। তা ছাড়া এ সারবার ব্যথাও নয়।

 ষোড়শী একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে কি করতে হবে?

 জীবানন্দ কহিল, শুধু বলতে হবে তুমি নিজের ইচ্ছেয় এসেচ, নিজের ইচ্ছেয় এখানে আছো। তার বদলে, তোমার সমস্ত দেবোত্তর ছেড়ে দেব, হাজার টাকা নগদ দেব, আর নজরের ত কথাই নেই।

২০