পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এককড়ি এই কথাগুলোরই বোধ হয় প্রতিধ্বনি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু ষোড়শীর মুখের পানে চাহিয়া সহসা থামিয়া গেল। ষোড়শী সোজা জীবানদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, একথা স্বীকার করার অর্থ বোঝেন? তারপরেও কী আমার জমিতে, টাকাকড়িতে প্রয়োজন থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

 জীবনন্দের মুখখানা প্রথমে ফ্যাকাশে হইল, এবং সেই পাণ্ডুর মুখের তীক্ষ্ণ তীব্র দুটি চক্ষে কোথা হইতে তাহার গত রাত্রির তেমনি স্নিগ্ধ মুগ্ধ দৃষ্টি যেন ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া স্থির হইয়া রহিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে একটা কথাও কহিল না, তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়া বলিল, তাই বটে ষোড়শী, তাই বটে। জীবনে আজও ত তুমি পাপ করোনি―ও তুমি পারবে না সত্যি।

 একটুখানি হাসিয়া বলিল, টাকাকড়ির বদলে যে সম্ভ্রম বেচা যায় না―ও যেন আমি ভুলেই গেছি! তাই হোক, যা সত্যি তাই তুমি বলো―জমিদারের তরফ থেকে আর কোন উপদ্রব তোমার ওপর হবে না।

 এককড়ি ব্যাকুল হইয়া আবার কি কতগুলো বলিতে গেল, কিন্তু বাহিরে রুদ্ধ দ্বারে পুনঃপুনঃ করাঘাতের শব্দে এবারেও তাহা বলা হইল না, কেবল তাহার মুখখানাই সাদা হইয়া রহিল।

 জীবানন্দ সাড়া দিয়া কহিল, খোলা আছে, ভিতরে আসুন। এবং পরক্ষণেই উন্মুক্ত দরজার সম্মুখে দেখা গেল ছোট-বড় জনকয়েক পুলিশ-কর্মচারীর পিছনে দাঁড়াইয়া স্বয়ং জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং তাঁহারই কাঁধের উপর দিয়া উঁকি মারিতেছে তারাদাস চক্রবর্তী। সে ভিতরে ঢুকিয়াই কাঁদিয়া বলিল, ধর্মাবতার, হুজুর! এই আমার মেয়ে, মা-চণ্ডীর ভৈরবী। আপনার দয়া না হলে আজ ওকে টাকার জন্যে খুন করে ফেলতো, ধর্মাবতার।

 কে-সাহেব ষোড়শীর আপাদমস্তক পুনঃপুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার নাম ষোড়শী? তোমাকেই বাড়ি থেকে ধরে এনে উনি বন্ধ করে রেখেছেন?

 ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, না, আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি।

 চক্রবর্তী চেঁচামেচি করিয়া উঠিল, না হুজুর, ভয়ানক মিথ্যে কথা! গ্রামসুদ্ধ সাক্ষী আছে। মা আমার ভাত রাঁধছিল, আটজন পাইক গিয়ে মাকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে টেনে এনেছে।

 ম্যাজিস্ট্রেট জীবানদের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া ষোড়শীকে পুনশ্চ বলিলেন, তোমার কোন ভয় নেই, তুমি সত্যি কথা বল। তোমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে?

 না, আমি আপনি এসেছি।

 এখানে তোমার কি প্রয়োজন?

 ষোড়শী শুধু কহিল, আমার কাজ ছিল।

 সাহেব একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন, সমস্ত রাত্রিই কাজ ছিল?

২১