পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আজ তাকে চেনবার সাহস পর্যন্ত আপনার হয় নি।

 জীবানন্দ কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া, অকস্মাৎ বলিয়া উঠিল, আজ আমি এত নীচে নেমে গেছি যে, গৃহস্থের কুলবধূর দোহাই দিলেও তুমি মনে মনে হাসবে, কিন্তু সেদিন অলকাকে বিবাহ করে বীজগাঁর জমিদার-বংশের বধূ বলে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই কি ভাল কাজ হতো?

 ষোড়শী অসঙ্কোচে উত্তর দিল, সে ঠিক জানিনে, কিন্তু সত্য কাজ হতো এ জানি। যার সমস্ত দুর্ভাগ্য জেনেও যাকে হাত পেতে নিতে আপনার বাধেনি, তাকে অমন করে ফেলে না পালালে এতবড় লাঞ্ছনা আজ আপনার ভাগ্যে ঘটতো না। সেই সত্যই আজ আপনাকে এ দুর্গতি থেকে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু আমি মিথ্যে বকচি, এখন এ-সব আর আপনার কাছে বলা নিষ্ফল। আমি চললাম―আপনি কোন-কিছু দেবার চেষ্টা করে আর আমাকে অপমান করবেন না।

 জীবানন্দ কিছুই কহিল না, কিন্তু এককড়িকে দ্বারপ্রান্তে দেখিতে পাইয়া সে হঠাৎ যেন কাঙ্গাল হইয়া বলিয়া উঠিল, এককড়ি, তোমাদের এখানে কোন ডাক্তার আছেন―একবার খবর দিয়ে আনতে পারো? তিনি যা চাবেন আমি তাই দেব।

 ষোড়শী চমকিয়া উঠিল। নিজের অভিমান ও উত্তেজনার মধ্য দিয়া এতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকেই আবদ্ধ ছিল।

 এককড়ি কহিল, ডাক্তার আছে বৈ কি হুজুর—আমাদের বল্লভ ডাক্তারের খাসা হাতযশ। বলিয়া সে সমর্থনের জন্য ভৈরবীর প্রতি চাহিল।

 ষোড়শী কথা কহিল না, কিন্তু জীবানন্দ ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তাঁকেই আনতে পাঠাও এককড়ি, আর এক মিনিট দেরি করো না। আর ঐখানে সব খালি বোতল পড়ে আছে—কাউকে বলে দাও গরম জল করে আনুক। কোথায় গেল এরা?

 এককড়ি কহিল, ঐ কথাটাই ত নিবেদন করতে আসছিলাম হুজুর, পুলিশের ভয়ে কে যে কোথায় সরেছে কাউকে খুঁজে পেলাম না।

 কেউ নেই, সব পালিয়েছে?

 সব, সব, জনপ্রাণী নেই। ওরা কি আর মানুষ হুজুর; কৈ, আমি ত―

 জীবানন্দ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, ডাক্তার আনা কি হবে না এককড়ি?

 এককড়ি বাধা পাইয়া মনে মনে লজ্জিত হইয়া কহিল, হবে না কেন হুজুর, আমি নিজেই যাচ্চি, এখনো তিনি ঘরেই আছেন। কিন্তু গরম জল করতে গেলে ত বড় দেরি হয়ে যাবে? তা ছাড়া হুজুরকে একলা―

 কিন্তু কথাটা শেষ হইবার সময় হইল না। ভিতরের একটা উচ্ছ্বসিত দুঃসহ বেদনায় জীবানন্দের মুখখানা চক্ষের পলকে বিবর্ণ হইয়া উঠিল, এবং ইহাকেই দমন করিতে সে উপুড় হইয়া পড়িয়া কেবল অস্ফুটকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, উঃ―আর আমি পারিনে।

 ষোড়শীকে কিসে যেন কঠিন আঘাত করিল। এতবড় করুণ, হতাশ কণ্ঠস্বরও যে এমন দুর্দান্ত পাষণ্ডের মুখ দিয়া বাহির হইতে পারে এ যেন তাহার স্বপ্নাতীত। আসলে মানুষ যে কত দুর্বল, কত নিরুপায়, দুঃখে বেদনায় মানুষে মানুষে যে

২৭