পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কানে গুনগুন করিয়া কি একটা অজানা রহস্যের অর্থ বলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। বোধ হয় ইহাতেই মগ্ন হইয়া সে নিজের ও পরের সুমুখের ও পশ্চাতের সমস্ত ভুলিয়া গিয়া অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ জীবানন্দেরর প্রশ্নেই তাহার হুঁশ হইল।

 অলকা!

 নামটাকে আর সে উপেক্ষা করিতে পারিল না। কহিল, আজ্ঞে?

 জীবানন্দ বলিল, এখনও সময় হয়নি? হয়ত তিনি আসবেন না, হয়ত কোথাও চলে গেছেন।

 ষোড়শী কহিল, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি আসবেন―তিনি কোথাও যাননি।

 বাড়িতে কেউ কি এখনও ফিরে আসেনি।

 ষোড়শী বলিল, না।

 জীবানন্দ একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বোধ হয় তারা আর আসবে না, বোধহয় এককড়িও একটা ছল করে গেল।

 ষোড়শী মৌন হইয়া রহিল। জীবানন্দ নিজেও বোধ হয় একটা ব্যথা সামলাইয়া লইয়া একটু পরেই বলিল, সবাই গেছে, তারা যেতে পারে―কেবল তোমারই যাওয়া হবে না।

 কেন?

 বোধকরি আমি বাঁচব না—তাই। আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্চে, পথিবীতে আর বুঝি হাওয়া নেই।

 আপনার কি বড্ড কষ্ট হচ্ছে?

 হুঁ। অলকা আমাকে তুমি মাপ কর।

 ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল। জীবানন্দ একটু থামিয়া পুনরায় কহিল, আমি ঠাকুর-দেবতা মানিনে, দরকারও হয় না। কিন্তু একটু আগেই মনে মনে ভাবছিলুম, জীবনে অনেক পাপ করেছি, তার আর আদি-অবধি নেই। আজ থেকে থেকে কেবলি মনে হচ্চে, বুঝি সব দেনা মাথায় নিয়ে যেতে হবে।

 ষোড়শী তেমনি নীরবেই দাঁড়াইয়া রহিল। জীবানন্দ কহিল, মানুষ অমরও নয়, মৃত্যুর বয়সও কেউ দাগ দিয়ে রাখেনি, কিন্তু এই যন্ত্রণা আর সইতে পারচি নে―উঃ―মাগো! বলিতে বলিতে তাহার সর্বশরীর ব্যথার অসহ্য তীব্রতায় যেন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।

 ষোড়শী চাহিয়া দেখিল, তাহার কেবল দেহই নয়, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে এবং বিবর্ণমুখে দুই নিমীলিত চক্ষের নীচে রক্তহীন ওষ্ঠাধর একটা অত্যন্ত কঠিন রেখায় সংবদ্ধ হইয়া গেছে।

 পলকের জন্য কি একটা সে ভাবিয়া লইল বোধ হয় একবার একটু দ্বিধাও করিল; তার পরে এই পীড়িতের শয্যায় হতভাগ্যের পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিল। গরম জলের বোতল-দুটো সাবধানে তাহার পেটের কাছে টানিয়া দিতে জীবানন্দ কেবল ক্ষণিকের জন্য একবার চোখ মেলিয়াই আবার মুদিত ফরিল। ষোড়শী আঁচল দিয়া

২৯