পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বড়কর্তা প্রথমে একটু বিস্মিত হইলেন, তারপরে বলিলেন, জানা গেছে বৈ কি মা বেশ ভাল করেই জানা গেছে। বলিয়া তিনি তারাদাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

 হৈম পিতার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া কহিল, পরশু থেকে ত সমস্তই শুনচি বাবা, তাতে কি ওঁর কথাটাই সত্যি বলে মেনে নিতে হবে?

 রায়মহাশয় ইহার ঠিক জবাবটা খুঁজিয়া না পাইয়া শুধু বলিলেন, নয়ই বা কেন শুনি?

 হৈম তারাদাসের পরবর্তী সেই ছোট মেয়েটাকে দেখাইয়া বলিল, ঐটিকে যখন যোগাড় করে এনেছেন, তখন মিথ্যে বলা কি এতই অসম্ভব বাবা? তা ছাড়া সত্যিমিথ্যে ত যাচাই করতে হয়, ও-ত একতরফা রায় দেওয়া চলে না।

 কথা শুনিয়া সকলেই আশ্চর্য হইল, এমন কি ষোড়শী পর্যন্ত বিস্মিতচক্ষে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। ইহার উত্তর দিলেন সর্বেশ্বর শিরোমণি। তিনি স্মিতহাস্যে মুখখানি সরস করিয়া কহিলেন, বেটী কৌঁসলীর গিন্নী কিনা, তার জেরা ধরেচে। আচ্ছা, আমি দিচ্চি থামিয়ে। বলিয়া তিনি হৈমর প্রতি চাহিয়া কহিলেন, এটা দেবীর মন্দির―পীঠস্থান। বলি, এটা ত মানিস?

 হৈম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মানি বৈ কি।

 শিরোমণি বলিলেন, তা যদি হয়, তা হলে তারাদাস বামুনের ছেলে হয়ে কি দেবমন্দিরে দাঁড়িয়ে মিছে কথা কইচে পাগলী? বলিয়া তিনি প্রবল হাস্যে সমস্ত স্থানটা গরম করিয়া তুলিলেন।

 তাঁহার হাসির বেগ মন্দীভূত হইলে হৈম কহিল, আপনি নিজেও ত তাই শিরোমণি জ্যাঠামশাই। অথচ এই দেবমন্দিরে দাঁড়িয়েই ত মিছে কথার বৃষ্টি করে গেলেন! আমি বলেচি ওঁকে দিয়ে পূজো করালে আমার কার্য সিদ্ধ হবে না, এর বিন্দুবিসর্গও সত্যি নয়!

 শিরোমণি হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, রায়মহাশয় মনে মনে অত্যন্ত কুপিত হইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিলেন, কে তোমাকে বললে হৈম সত্যি নয়, শুনি?

 হৈম একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমিই বলচি, সত্যি নয় বাবা। তার কারণ আমি কখনো এমন কথা বলা ত দূরে, মনেও করিনে। আমি ওকে দিয়েই পূজো করাবো; এতে আমার ছেলের কল্যাণই হোক, আর অকল্যাণই হোক। ষোড়শীর প্রতি চাহিয়া বলিল, আপনি হয়ত আমাকে চিনতে পারচেন না, কিন্তু আমার আপনাকে তেমনি মনে আছে। চলুন মন্দিরে, আমাদের সময় বয়ে যাচ্ছে। বলিয়া সে একপদ অগ্রসর হইয়া বোধ হয় তাহার কাছেই যাইতেছিল, কিন্তু নিজের মেয়ের কাছে অপমানের এই নিদারুণ আঘাতে পিতা ধৈর্য হারাইয়া ফেলিলেন; তিনি অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীষণকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, কখনো না। আমি বেচে থাকতে ওঁকে কিছুতেই মন্দিরে ঢুকতে দেব না। তারাদাস বল ত ওর মায়ের কথাটা! একবার শুনুক সবাই। ভেবেছিলাম ওটা আর তুলতে হবে না, সহজেই হবে।

 শিরোমণি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, না তারাদাস, থাক। ওর কথা

৪০