পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বুঝিলেন উপস্থিত ক্ষেত্রে তিনি প্রকাশ্যে ধনী কন্যা-জামাতার বিরুদ্ধাচরণ করিতে পারেন না। অল্পকালেই তাঁহার রক্তচক্ষু অবনত হইয়া আসিল, এবং কাহাকেও আর একটি কথাও না কহিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে মন্দির-প্রাঙ্গন ত্যাগ করিয়া গেলেন। দুই-চারিজন অনুগত ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাঁর সঙ্গ রইল না। বৃদ্ধ শিরোমণিমহাশয় রহিয়া গেলেন, এবং অনেকেই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি গড়ায়, জানিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিল।

 হৈম মিনতি করিয়া কহিল, মা-ভৈরবীর আশীর্বাদ আমরা মাতা-পুত্র মাথায় করে নিলাম, কিন্তু সে আশীর্বাদ আমি আপনাকে দিয়েই পাকা করে নিতে চাই দিদি। বেশ, আমি অপেক্ষা করতে পারব; পূজো আজ বন্ধ থাক―যে দিন আপনি আদেশ করবেন এই উদ্যোগ-আয়োজন আবার না হয় সেই দিনই হবে।

 ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, সে সুবিধে আর হবে কিনা এ কথা ত আজ তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারবো না বোন।

 হৈম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তবে কি মা-চণ্ডীর ভৈরবী আর আপনি থাকবেন না:

 ষোড়শী শুধু বলিল, আজও ত তাই আছি।

 হৈম কহিল, তবে? বলিয়াই দেখিতে পাইল দ্বারের চৌকাঠ ধরিয়া শিরোমণি দাঁড়াইয়া আছেন। চোখাচোখি হইতেই তিনি সদর্পে অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন, তোমার বাবা আর আমি সেই কথাই ত এতক্ষণ বকে মরচি গো! ভালো, আমাদের সব সইবে। উনি কাল হোক, পরশু হোক, দু’দিন পরে হোক, দশদিন পরে হোক, পূজা করুন। দিন তার জবাব!

 হৈম ষোড়শীর মুখের প্রতি নির্নিমেষে চাহিয়া রহিল, কিন্তু সে তার কোন উত্তর দিল না।

 শিরোমণি ভৈরবীর ম্লানমুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সহাস্যে কহিল, মা হৈম, এ ত সোজা প্রশ্ন নয়! এ পীঠস্থান, জাগ্রত দেবতা, দেবীর ভৈরবী ছাড়া এ দেব-অঙ্গ স্পর্শ করা ত যে-সে স্ত্রীলোকের কর্ম নয়! বুকের জোর থাকে, থাকুন উনি মায়ের ভৈরবী―আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা জানি সে আর ওঁর সাধ্যই নেই।

 ইঙ্গিতটা এতই সুস্পষ্ট যে লজ্জায় হৈমর পর্যন্ত মাথা হেঁট হইয়া গেল। ষোড়শী নিজেও অভিভূতের মত ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অকস্মাৎ আপনাকে আপনি ধাক্কা মারিয়া যেন সম্পূর্ণ সচেতন করিয়া তুলিল। শিরোমণিকে সে কোন উত্তর করিল না, কিন্তু বুড়ো পূজারীকে হঠাৎ একটা ধমক দিবার মত তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, ছোট ঠাকুরমশাই, তুমি ইতস্ততঃ করচ কিসের জন্যে? আমার আদেশ রইল, দেবীর পূজা যথারীতি সেরে তুমি নিজের প্রাপ্য নিয়ে, বাকী মন্দিরের ভাঁড়ারে বন্ধ করে চাবি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। হৈমর প্রতি চাহিয়া কহিল, অনেক আয়োজন করেচ, এ-সব নষ্ট করা উচিত হবে না, ভাই। আমি আশীর্বাদ করে যাচ্চি এতেই তোমার ছেলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে। আমার নিজের পূজা-আহ্নিক এখনো বাকী রয়েছে, আমি এখন চললাম―সময় পাই ত আবার আসব। এই বলিয়া সে আর বাদানুবাদ না

৪২