পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অপরাহ্ন। আসিয়া দেখিল তাহার পিতা কিংবা শিরোমণিমহাশয় কেহই এতক্ষণ আলস্যে সময় কাটান নাই। বাহিরে বসিবার ঘরে তুমুল কোলাহল হইতেছে। তাহার প্রাবল্য দেখিয়া সহজেই বুঝা গেল একযোগে অনেকগুলি বক্তাই স্ব স্ব মন্তব্য প্রকাশের প্রয়াস করিতেছেন। অলক্ষ্যে কোনমতে পাশ কাটাইয়া তাহার বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পিতার দৃষ্টি এড়াইতে পারিল না; তিনি হাত নাড়িয়া আহ্বান করিয়া কহিলেন, হৈম, এদিকে একবার শুনে যা ত মা!

 সে ক্লান্ত দেহে মলিন মুখে ধীরে ধীরে গিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইয়াই দেখিল তথায় একটিমাত্র প্রাণী নীরবে বসিয়া আছেন, যাঁহাকে শ্রোতা বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে―সে তাহার স্বামী মিস্টার এন, বসু, ব্যারিস্টার। সকলের সমবেত বক্তৃতার উপলক্ষ একমাত্র তিনিই। বেলা দেড়টার ট্রেনে তাহার আসিবার একটা কথা ছিল বটে, কিন্তু ঠিক কিছু ছিল না। স্বামীকে দেখিয়া সে মাথার কাপড়টা আর একটু টানিয়া দিয়া দ্বারের অন্তরালে সরিয়া দাঁড়াইল। তাহার পিতা সস্নেহ অনুযোগের কণ্ঠে বলিলেন, তখন না বুঝে-সুঝে আমাদের কথায় হঠাৎ রাগ করে ফেললে মা, কিন্তু এখন নিজের কানেই ত সব শুনলে? ব্যাপার বুঝতে ত আর তোমার বাকী নেই, এখন তুমিই বল দেখি মা, অমন মেয়েমানুষকে কি ঠাকুর-দেবতার স্থানে রাখা যায়? এ ত ছেলেখেলা নয়!

 হৈম অত্যন্ত মৃদুস্বরে জবাব দিল, আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন।

 তাহার পিতা হাস্য করিলেন, কহিলেন, করব বৈ কি মা, করব বৈ কি। করতেই ত গিয়েছিলাম। নির্মল এসেচে ভালই হয়েছে। যদি একটা মামলা-মকদ্দমাই বাধে ত বল পাওয়া যাবে। অপর পক্ষে বোধ করি তিনি জমিদারের সাহায্যের আশঙ্কাই করিলেন, কিন্তু শিরোমণি খামকাই উত্তপ্ত হইয়া উঠিলেন এবং হাঁকিয়া কহিলেন, ঘাড় ধরে বার করে দেব তার অবির নালিশ-ফরিয়াদ কি হে জনার্দন। জামাইবাবাজী যখন উপস্থিত আছেন, তখন তিনিই বিচার করুন। তিনিই আমাদের জজ, তিনিই তামাদের ম্যাজিষ্টর! আমরা অন্য জজ-ম্যাজিষ্টর মানিনে। কি বল হে যোগেন ভায়া? তুমি কি বল হে মিত্তিরজা? এই বলিয়া তিনি কয়েকজনের মুখের প্রতি সস্মিত দৃষ্টিপাত করিয়া সহসা কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। এক্ষেত্রে যোগেন ভায়া ও মিত্তিরজার সম্মতিগ্রহণের তাৎপর্য ঠিক বুঝা গেল না, কিন্তু এটা বুঝা গেল, বড়লোক এবং দানশীল জামাইবাবাজী বিচার করুন, আর না করুন, ভবিষ্যতে তাঁহার অনুগ্রহ লাভের পথটা শিরোমণি নিজের জন্য কথঞ্চিৎ প্রশস্ত এবং সুগম করিয়া রাখিলেন।

 এই জামাইবাবাজী মানুষটির মাথার ডগা হইতে জুতার তল পর্যন্ত সমস্তই নিষ্কলঙ্ক সাহেবী। সুতরাং প্রত্যুত্তরে মৃদু-মধুর হাসিয়া তিনিও যে জবাবটুকু দিলেন তাহাও নিখুঁত সাহেবী। কহিলেন এই সব মোহন্ত-মোহন্তানী জাতের লোকগুলোর ব্যাপার সবাই জানে, এরা যেমন অসাধু, তেমনি অসচ্চরিত্র। এদের অসাধ্য কাজ নেই! কোন কারণেই এদের প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত। কিন্তু আপনাদের ভৈরবীটি ঠিক কি করেচেন না-করেচেন সেটাও নিশ্চিত জানা উচিত।

88