পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করেছিলেন, তুমি তার সঙ্গে যাবে। এমন কি, আর একটা পালকি আনিয়ে যাই যাই করেও তার শেষ পর্যন্ত ভরসা ছিল হয়ত তুমি ফিরে আসবে।

 এবার ষোড়শী কথা কহিল, বলিল, তাঁর আশা-ভরসার জন্যও কি আমাকে দায়ী হতে হবে?

 ফকির তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, নিশ্চয় না, নিশ্চয় না। কিন্তু কথাটা শুনতেও নাকি বিশ্রী, তাই উল্লেখ করলাম। আচ্ছা মা, যে ব্যাপারটায় সকল কুৎসিত অবস্থার সৃষ্টি তার যথার্থ হেতুটা কি তুমি আমাকে বলতে পারো না? ও লোকটাকে যে তুমি কেন এমন করে বাঁচিয়ে দিলে এর কোন মীমাংসাই ত খুঁজে পাইনে ষোড়শী?

 ষোড়শীর প্রথমে মনে হইল এ প্রশ্নেরও সে কোন উত্তর দিবে না, কিন্তু বৃদ্ধের উদ্বিগ্ন মুখের স্নেহ-করুণ চোখ-দুটির প্রতি চাহিয়া সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, কহিল, ফকিরসাহেব, ওই পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানোই কি উচিত হতো?

 ফকির বিস্মিত হইলেন, মনে মনে বোধ করি বা একটু বিরক্তও হইলেন, বলিলেন, সে বিবেচনার ভার ত তোমার নয় মা, সে রাজার। তাই তাঁর জেলেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করান। কিন্তু এই যদি হয়ে থাকে, তুমি অন্যায় করেচ বলতে হবে।

 ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

 ফকির বলিলেন, যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এর ত্রুটি শুধরে নিতে হবে।

 ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, তার অর্থ?

 ফকির বলিলেন, ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই, এ ত তুমি জানো। তার শাস্তি হওয়া উচিত।

 এবার ষোড়শী বহুক্ষণ পর্যন্ত নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপরে মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের উচিত, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়―তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।

 ফকির কহিলেন, ব্যাপার কি ষোড়শী?

 ষোড়শী আধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কোন বাক্যই বাহির হইল না। দাসী সংসারের কাজ করিতে আসিতেছিল, দ্বারের কাছে তাহাকে দেখিতে পাইয়া ফকির আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, এখন তা হলে আমি চললাম।

 ষোড়শী কেবল হেঁট হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল; তিনি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।

 তাঁহার প্রশান্ত মুখের গম্ভীর বিষণ্ণতাই শুধু যে কেবল ষোড়শীর সমস্ত দিন সকল কাজকর্মের মধ্যেই যখন-তখন মনে হইতে লাগিল তাই নয়, যে অনুচ্চারিত বাক্য তিনি

৫১