ষোড়শী একেবারেই নির্বাক। বসুসাহেব নিজেও কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, এরা যে আপনাকে সহজে ছাড়বেন তা মনে হয় না। খুব সম্ভব মামলা-মকদ্দমাও হবে। ফকিরসাহেব হয়ত সত্যি চলে গেছেন, আমিও বোধ হয় থাকব না―
ষোড়শী কিছুই বলিল না। তিনি নিজেও একটু মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আপনি নিজে আর দেবীর পূজো করবেন না বলেছেন, এ কি রাগ করে?
ষোড়শী এবার জবাব দিল, কহিল, না।
তা হলে এর কি সত্যিই কোন কারণ আছে?
ষোড়শী এ প্রশ্নের উত্তর দিল না, কিন্তু কথা কহিল, বলিল, আমরা এবার নদীতে এসেচি, আপনাকে একটু সাবধানে নামতে হবে।
ইহার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথাই হইল না! ষোড়শী সযত্নে সাবধানে তাঁহাকে জল পার করিয়া লইয়া গেল। আসিবার সময় সাহেব জুতা খুলিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আর সাহস করিলেন না, যেমন ছিলেন তেমনই গিয়া পরপারে উঠিলেন। একটি তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, একটা মস্ত ফাঁড়া কেটে গেল, বাঁচলাম।
এই মস্ত ফাঁড়া কাটাইয়া দিয়া সাহেব অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত হইয়া কহিলেন, পূজারী একজন আছেন বটে, কিন্তু পূজাটা আপনারও একটা কাজের মধ্যেই। অথচ সে প্রশ্নটা আপনি চাপা দিলেন। এদিকে যে ভীষণ দুর্দান্ত শয়তান জমিদারটাকে বাঁচানো আপনার কর্তব্যের অঙ্গ ছিল না, তাঁকে যে উপায়ে বাঁচালেন তা কেবল আশ্চর্য নয়, অদ্ভুত। এই দুটো ব্যাপারই এমন দুর্বোধ্য যে, গ্রামের লোক বুঝলে না বলে অভিমান করা চলে না!
ষোড়শী তেমনি মৃদুস্বরেই এ অনুযোগের জবাব দিয়া কহিল, অভিমান আমি করিনি।
বসু বলিলেন, করেন নি। সেও অদ্ভুত। আপনার বাবার আচরণ আবার আরও অদ্ভুত। হৈম বলে―কিন্তু হৈমর কথা এখন থাক। কিন্তু আমি বলি, এদের সমস্ত অপরাধটা কেন বুঝিয়েই বলুন না? তাতে কতটা কাজ হবে আমি জানিনে, কিন্তু সে যাই হোক, নারীর সুনামটা ত অবহেলার বস্তু নয়! বলিয়া তিনি কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন; কিন্তু ষোড়শী কোন প্রত্যুত্তরই যখন দিল না, তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, বুঝা গেল এই সুনাম-দুর্নাম সম্বন্ধে সাধারণ রমণীর মত আপনার বিশেষ কোন মাথাব্যথা নেই। আর সাধারণও ত আপনি নন। তা ছাড়া চুপ করে থাকার এই জিদ―এত অদ্ভুত। বাস্তবিক, আপনার সকলই অদ্ভুত। বলিয়া নিজে একটুখানি চুপ করিয়া কহিলেন, সেদিন একটিবার মাত্র আপনাকে দেখেচি, আর আজ হাত ধরে এগিয়ে চলেছি। যাকে আশ্রয় করেচি, তিনিও আমার কাছে যেমন অন্ধকার, যার মধ্যে দিয়ে চলেচি সেও তেমনি অন্ধকার। তবুও নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচের যাত্রা করার কোন বাধা হয়নি। আপনাকে ভক্তি না করে
৫৭