পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি, ইনি যেমন গভীর, তেমনি শিক্ষিত, তেমনি নিঃশঙ্ক। শাস্ত্রে বলে, সাত পা এক সঙ্গে চললে বন্ধুত্ব হয়; এতবড় পথটায় এই দুর্ভেদ্য আঁধারে নিতান্ত তাঁকেই নির্ভর করে অনেক পা আমরা একসঙ্গে চলে এসেচি, একটি একটি করে অনেক প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেচি, কিন্তু কালও তিনি যেমন রহস্যে ঢাকা ছিলেন আজও তেমনি রয়ে গেলেন।

 হৈম কহিল, তোমার জেরাও মানলে না, বন্ধুত্বও স্বীকার করলে না?

 নির্মল কহিল, না, কোনটাই হলো না।

 হৈম এবার হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, একটুও না? তোমার দিক থেকেও না?

 নির্মল কহিল, এতবড় কথাটা কেবল ফাঁকি দিয়ে বার করে নিতে চাও। কিন্তু নিজেকে জানতেও যে দেরি লাগে হৈম। কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সে থমকিয়া গেল। চাহিয়া দেখিল, হৈমও তাহার প্রতি দুই চক্ষের স্থিরদৃষ্টি পাতিয়া আছে। তাহার মুখে কি ভাব প্রকাশ পাইল, প্রদীপের স্বল্প আলোকে ঠিক বোঝা গেল না। এবং সে নিজেও যে নিজের পূর্বকথার যোগ রাখিয়া হঠাৎ কি বলিবে, ভাবিয়া স্থির করিবার পূর্বেই হৈম ধীরে ধীরে কহিল, সে ঠিক। তবু পুরুষমানুষদের বুঝতে হয়ত একটু দেরিই হয় কিন্তু মেয়েমানুষের এমনি অভিশাপ যে, আমরণ নিজের অদৃষ্টকে বুঝতেই তার কেটে যায়। আচ্ছা তুমি ঘুমোও, আমি এখনি আসচি, বলিয়া সে আর কোন কথার পূর্বেই উঠিয়া সাবধানে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বাহিরে চলিয়া গল।

 নির্মল তাহার হাত ধরিল না―রহস্যের অন্তরালে স্ত্রীর এই অর্থহীন সংশয় ও অবিচারের বেদনা তাহাকে যেন অকস্মাৎ ক্রোধে চঞ্চল করিয়া তুলিল। সুমুখের বড় ঘড়িটায় অত্যন্ত ক্লেশকর মিনিটের কাঁটাটা নড়িতে নড়িতে নীচে ঝুলিয়া পড়িল, কিন্তু তখন পর্যন্ত যখন সে ফিরিয়া আসিল না, তখন আর সে একাকী শয্যায় থাকিতে না পারিয়া ধীরে দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্ধকার বারান্দায় একটা থামের পাশে হৈম চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কাছে আসিয়া মাথায় গায়ে হাত দিয়া দেখিল, বৃষ্টির ছাটে সমস্ত ভিজিয়া গেছে। হাত ধরিয়া ঘরে আনিয়া কহিল, তুমি কি পাগল হয়েচ হৈম?

 ইহার অধিক আর তাহার মুখেও আসিল না, আসার প্রয়োজনও বোধ করিল না। প্রদীপের আলোকে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া দেখিল, অশ্রুর আভাস চোখের কোণ হইতে তখন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় নাই।

৬২