পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ইহার উত্তর তাহার স্বামীর নিকট হইতে আসিল, সে কহিল, এ ছাড়া আর কি উপায় আছে বলতে পারো? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবা রাত্রি বিবাদ করে টিকতে পারে না। ষোড়শীকে কহিল, এই ভাল। যদি স্বেচ্ছায় এইখানে থাকাই সঙ্কল্প করে থাকেন এবং কুটীরও অভ্যাস হয়ে যাবে বিশ্বাস করে থাকেন―সংসারে কিছুই ত্যাগ করা আপনার শক্ত হবে না।

 ষোড়শী মৌন হইয়া রহিল এবং তাহার মুখ দেখিয়াও তাহার মনের কথা কিছুই বুঝা গেল না।

 হৈম বলিল, তুমি সন্নাসিনী, বিষয়-আশয় ছাড়া তোমার কঠিন নয়, কুঁড়েও তোমার সইবে আমি জানি, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?

 ষোড়শী হাসিমুখে ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া বলিল, দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে আবার মিথ্যে কাজের সৃষ্টি হয় তার গুরুভারটাই সওয়া যায় না।

 হৈম কহিল, কিন্তু এককড়ি নন্দী যে কথা এবং কাজ দুই-ই মিথ্যে রটিয়ে বেড়াচ্ছে? মেয়েমানুষের জীবনে সে যে অসহ্য।

 ষোড়শী লেশমাত্র উত্তেজিত হইল না, আস্তে আস্তে কহিল, আমি যতদূর শুনেচি, এককড়ি মিথ্যে ত বিশেষ বলেনি। জমিদারবাবু হঠাৎ অত্যন্ত পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন, ঘরে আর কেউ ছিল না―আমি তাঁর সেবা করেছি। এ ত অসত্য নয়!

 হৈম উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। আর একজনের ধীরতার তুলনায় তাহার কণ্ঠস্বর কিছু অনাবশ্যক তীক্ষ্ণ শুনাইল, কহিল, কিন্তু সকলেই ত সব কাজ পারে না দিদি। আর্তের সেবা করারও ত একটা ধারা আছে।

 ষোড়শী তেমনি মৃদুকণ্ঠে বলিল, আছে বৈ কি। কিন্তু স্থান কাল না বুঝে কেবল বাইরে থেকে ধারাটা স্থির করে দেওয়া যায় না হৈম। আপনি কি বলেন? এই বলিয়া সে নির্মলের প্রতি চাহিয়া একটু হাসিল।

 নির্মল এ ইঙ্গিত সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিয়া কহিল, অন্ততঃ আমি ত কোনমতেই অস্বীকার করতে পারিনে। তা ছাড়া কাজের ধারা সকলের একও নয়―এই যেমন সন্ন্যাসিনীর।

 স্বামীর এই উক্তিটাকে হৈম তলাইয়া দেখিল না, কহিল, হোক সন্ন্যাসিনী, কিন্তু তার কি ধর্ম নেই? তিনি কি নারী নন? আপনাকে সে ঘর থেকে ধরিয়ে নিয়ে গেল, অথচ বললেন নিজে গিয়েছিলেন। এই মিথ্যের কি আবশ্যক ছিল? তার অসুখ ত কেবল নিজের দোষে। তবুও এতবড় ঘোর পাপিষ্ঠকে বাঁচাবার আপনার কি দরকার ছিল? এর পরেও মানুষে যদি সন্দেহ করে, সে কি তাদের দোষ?

 স্ত্রীর কথা শুনিয়া নির্মল ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে জানিত, অভিযোগ করিতে হৈম ঘর হইতে বাহির হয় নাই―বাড়ি চড়িয়া অপমান করিবার মত

৬৭