পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকাটা তার হাতে পড়বে না, কারণ তাকে খুঁজে পাবেন না। এই অন্ধ মানুষটিকে অমন করে দিয়ে না গেলে যে কি হতো সে কেবল আমিই জানি, আর আমিই কেবল তার নাম জানি। কিন্তু টাকাকড়ি ত তাকে দেবার জো নেই―তাই কেবল একটু পায়ের ধূলো নিতে―বলিয়া সে তাহার হাতখানি টানিয়া লইবার চেষ্টা করিতেই ষোড়শী নিজের মুঠাটা শক্ত করিয়া রাখিয়া কেবল একটু হাসিল।

 হৈম বাঁ হাত দিয়া তাহার চোখের কোণটা মুছিয়া লইয়া হাসিয়া কহিল, পায়ের ধূলো দিতে হবে না দিদি, মুঠোটা একটু আলগা কর―আমার হাত ভেঙ্গে গেল। শক্ত কেবল মনই নয়, হাতটাও কম নয়। ইস্পাতের তলোয়ারটা কি সাধে মনে পড়ে! কিন্তু এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয় এই প্রবাসী বোনটিকে তখন স্মরণ করবে?

 ষোড়শী তাহার হাতের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে লাগিল, কিছুই বলিল না।

 হৈম কহিল, তাহলে কথা দিতে চাও না?

 ষোড়শী বলিল, আমার জন্যে তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয় এই কি আমি চাইতে পারি ভাই?

 নির্মল কহিল, ঝগড়া না করেও ত অনেক জিনিস করা যায়?

 ষোড়শী বলিল, আমি বলি তা-ও আপনাদের চেষ্টা করে কাজ নেই। কিন্তু তাই বলে প্রবাসী বোনটিকেও আমি ভুলে যাবো না। আমার খবর আপনারা পাবেন।

 চাকরটা এতক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরে বসিয়া ছিল, সে কহিল, মা, কালকের মত আজও ঝড় জল হতে পারে―মেঘ উঠেছে!

 হৈম বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিয়া প্রণাম করিয়া এবার পায়ের ধূলা লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। নির্মল হাত তুলিয়া একটা নমস্কার করিয়া কহিল, আমি চিরদিন ঋণীই রয়ে গেলাম, শোধ দেবার আর কোন পথ রইল না। আদালতের মানুষ, বিষয়-সম্পত্তিওয়ালা ভৈরবীর কাজে লাগলেও লাগতে পারতাম, কিন্তু কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসিনীরা আমাদের হাতের বাইরে। সমস্ত না ছেড়েও উপায় ছিল না সত্যি, কিন্তু ছেড়েও যে উপায় হবে তা ভরসা হয় না।

 ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কে বললে আমি সমস্ত ছেড়ে দিয়েছি। আমি ত কিছুই ছাড়িনি।

 নির্মল ও হৈম উভয়েই অবাক হইয়া একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, ছাড়েন নি? কোন বস্তুই ত্যাগ করেন নি?

 ষোড়শী তেমনি শান্তসহজ-কণ্ঠে কহিল, না, কিছুই না। আমি স্ত্রীলোক, আমি নিরুপায়, কিন্তু আমার ভৈরবীর অধিকার একতিল শিথিল হয়নি। তাঁরা পুরুষমানুষ, তাঁদের জোর আছে, কিন্তু সেই জোরটা তাঁদের ষোল আনা সপ্রমাণ না করে আমার হাত থেকে কিছুই পাবার জো নেই―মাটির একটা ঢেলা পর্যন্ত না। নির্মল

৬৯