পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যাব, আমি মেয়েমানুষ, কিন্তু সংসারে সেটাই আমার বড় অপরাধ যাঁরা স্থির করে রেখেছেন, তাঁরা ভুল করেছেন। এ ভ্রম তাঁদের সংশোধন করতে হবে।

 কথা শুনিয়া দুজনেই স্তব্ধ হইয়া রইল। ঘরে তখনও আলো জ্বলে নাই―অন্ধকারে তাহার মুখ, তাহার চোখ, তাহার ক্ষীণ দেহের অস্পষ্ট ঋজুতা ভিন্ন আর কিছুই লক্ষ্য হইল না, কিন্তু এই শান্ত অবিচলিত কণ্ঠস্বরও যে মিথ্যা আস্ফালন উদ্গীর্ণ করে নাই, তাহা মর্মের মাঝখানে গিয়া উভয়কেই সবলে বিদ্ধ করিল।

 অনতিদূরে পথের বাঁকটার কাছে একটা গোলমাল শুনা গেল। আগে এবং পেছনে কয়েকটা আলোর সঙ্গে গোটা-দুই পালকি চলিয়াছে।

 অন্ধকারে নজর করিয়া দেখিয়া নির্মল কহিল, জমিদারবাবু তাহলে আজই পদধূলি দিলেন দেখচি।

 ষোড়শী ভিতর হইতে সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, জমিদারবাবু! তাঁর কি আসবার কথা ছিল? বলিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

 নির্মল কহিল, হাঁ, তাঁর নদীর ধারের নরককুণ্ডর ঝাড়ামোছা চলছিল। এককড়ি বলছিল, শরীর সারাবার জন্যে হুজুর আজকালের মধ্যেই স্বরাজ্যে পদার্পণ করবেন। করলেনও বটে।

 ষোড়শী নির্বাক হইয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। বিদায় লইয়া নির্মল আস্তে আস্তে কহিল, যত দূরেই থাকি, আমরা বেঁচে থাকতে নিজেকে একেবারেই নিরুপায় এবং নিরাশ্রয় ভেবে রাখবেন না। বলিয়াই সে হৈমর হাত ধরিয়া অন্ধকারে অগ্রসর হইল। ষোড়শী তেমনি স্থির তেমনি স্তব্ধ হইয়াই রহিল, এ কথার কোন উত্তর দিল না।

বার

 বিপুলকায় মন্দিরের প্রাচীরতলে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরীর পালকি দুটো নিমেষে অন্তর্হিত হইল। এই অত্যন্ত আঁধারে মাত্র ওই গোটাকয়েক আলোর সাহায্যে মানুষের চক্ষে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু ষোড়শীর মনে হইল লোকটিকে সে যেন দিনের মত স্পষ্ট দেখিতে পাইল! এবং শুধু কেবল তিনিই নয়, তাঁহার পিছনে ঘেরাটোপ ঢাকা যে পালকিটি গেল, তাহার অববোধের মধ্যেও যে মানুষটি নিঃশব্দে বসিয়া আছে তাহারও শাড়ির চওড়া কালাপাড়ের একপ্রান্ত ঈষন্মুক্ত দ্বারের ফাঁক দিয়া ঝুলিয়া আছে, সেটুকুও যেন তাহার চোখে পড়িল। তাহার হাতে তীর-কাটা চুড়ির স্বর্ণাভ লণ্ঠনের আলোকে পলকের জন্য যে খেলিয়া গেল এ-বিষয়েও তার সংশয় রহিল না! তাহার দুই কানে হীরার দুল ঝলমল করিতেছে, তাহার আঙুলে আঙটির পাথরের সবুজ রঙ ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। সহসা কল্পনা তাহার বাধা

৭০